জকিগঞ্জে প্রশিক্ষণের নামে আড়াই কোটি টাকা ‘আত্মসাৎ’

তরুণ-তরুণীদের আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পাঁচ বছর আগে বেকারদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর একটি প্রকল্প শুরু করে। সিলেটের জকিগঞ্জে এই প্রকল্প শেষ হলেও আবার টাকা বরাদ্দ দিয়ে চলতি বছরের জুনে সে টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সেখানে টাকা বরাদ্দ হওয়ারও কথা নয়, তুলতে পারারও কথা নয়।

এভাবেই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ওই কর্মসূচির ব্যয় না হওয়া প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ‍তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের নামে টাকা লোপাটের এ অভিযোগ উঠেছে খোদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। আরেকটি কমিটি তদন্ত শেষ করেছে।

২০০৯-১০ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর চালু করে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি। দেশ থেকে বেকারত্ব দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। প্রথম পর্বে ‍কুড়িগ্রাম, বরগুনা ও গোপালগঞ্জ- এ তিন জেলার ৫৬ হাজার ৫৫ জন তরুণ-তরুণী এ কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের দুই বছরের অস্থায়ী নিয়োগ হয়। এ সময় তাদের বেতন হয় অধিদপ্তরের কাছ থেকে। চাকরি চলাকালে প্রথম তিন মাসে ভাতা দেওয়া হয় প্রতিদিন ২০০ টাকা। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। এভাবেই বেকার কমিয়ে আত্মকর্মসংস্থান করে কর্মসূচিটি।

এ পর্যন্ত ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সাতটি পর্ব বাস্তবায়ন করেছে অধিদপ্তর। কর্মসূচির আওতায় দেশের ৩৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের ৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ কর্মসূচির পঞ্চম পর্বে ছিল ২৪টি উপজেলায় যুবাদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান। এ পর্বে বরাদ্দ ছিল ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়নি প্রায় ৫৯ কোটি টাকা। এই পর্বেই ছিল সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা।

জকিগঞ্জে প্রশিক্ষণ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। কর্মসূচি শেষ হয় ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। অথচ চলতি বছরের ১২ জুন জকিগঞ্জ উপজেলার প্রায় আড়াই কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এ টাকা ওঠানো হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাজেট বরাদ্দ, টাকা তোলাসহ আর্থিক লেনদেনের সমন্বিত অনলাইন সিস্টেম আইবাস++ সফটওয়্যারের মাধ্যমে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের এক উপ-পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পঞ্চম পর্বের বেশিরভাগ টাকাই লুটপাট করেছেন স্বয়ং অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে এই বাজেট বরাদ্দ হয়।

এদিকে আড়াই কোটি টাকা তছরুপের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। ওই কমিটি একটি প্রতিবেদনও দেয় গত ২১ সেপ্টেম্বর।

অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি সেল) খোন্দকার মো. রুহুল আমীনের স্বাক্ষর করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বরাদ্দ আদেশ ছাড়াই ২০২১-২২ অর্থবছরে জকিগঞ্জ উপজেলার বিপরীতে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা আইবাস++ এ এন্ট্রি দেওয়া, উত্তোলন এবং ব্যয় হয়েছে। এটি আর্থিক বিধিবিধান পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এই অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ হওয়ার তালিকায় জকিগঞ্জ উপজেলার নামই নেই।

প্রাথমিক তদন্তে আরও উঠে এসেছে, টাকা এন্ট্রি দেওয়া ও তোলার কাজে জকিগঞ্জ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আজহারুল কবীরসহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় অ্যাকাউন্টস অফিসের কিছু কর্মচারীর একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় এনে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জকিগঞ্জ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আজহারুল কবীরের মোবাইল ফোনে কল করে, মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এসেছে, সরকারি অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আজহারুল কবীরের সরাসরি জড়িত থাকার এবং অন্যদের যোগসাজশের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি যুব ‍উন্নয়ন অধিদপ্তরে অডিট করা হয়। এ সময় অডিট কমিটি ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বাজেটে এ দুর্নীতির তথ্য দেয়। ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির পরিচালক পরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আর্থিক এ অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেন।

আড়াই কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির পরিচালক খোন্দকার মো. রুহুল আমীন প্রথমে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পরে তিনি বলেন, আইবাস++ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরকারি টাকার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। কে এন্ট্রি দিচ্ছে, কে টাকা তুলছে, কার নামে বরাদ্দ সব দেখা যায়। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে কমিটি করা হয়েছে। সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রকল্পের টাকা এভাবে তুলে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজহারুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে একাধিকবার কল করে এবং মেসেজে প্রশ্ন পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সূত্র : দৈনিক বাংলা