বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, মুক্তচিন্তার ধারণা আজকাল অলীক স্বপ্নের মতো মনে হয়, যা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের প্রভাবে ম্লান। প্রচলিত রাজনীতিতে বর্তমানে যা হচ্ছে, সহজ ভাষায় আমরা এই চর্চাকে বলি তেলবাজির রাজনীতি বলি, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই এই ধারা অব্যাহত। গণতান্ত্রিক ধারায় ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক বাগ্মিতা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক অভিনেতারা তাদের নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট এজেন্ডাগুলির দিকেই নজর রাখেন, এই গণ্ডির বাইরে গিয়ে আত্মসমালোচনা বা দলীয় সমালোচনার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত রাজনৈতিক মুক্তচিন্তাকে আইজ্যাক আসিমভের অবাস্তব কল্পকাহিনী মনে হতে পারে। বঙ্গ ভূখণ্ডে তথাকথিত রাজনৈতিক আদর্শের বৃত্তে যেখানে আত্মস্বার্থ এবং স্বজনপ্রীতি সর্বোচ্চ রাজত্ব করে সেখানে মুক্ত চিন্তাভাবনা প্রায় অসম্ভব।
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার গণতান্ত্রিক অপসংস্কৃতি যা প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অন্বেষণের জন্য মূল অন্তরায়। রাজনীতিতে শুরু হয়েছে ব্যক্তি এবং দলগুলির ক্ষমতা অর্জন এবং বজায় রাখা, তাদের এজেন্ডাগুলিকে এগিয়ে নেওয়া আর প্রভাব প্রতিপত্তির অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী ও সুরক্ষিত করার সিন্ডিকেটমুখি অপকৌশল। যার অর্থ স্বাধীন চিন্তা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বা দলীয় কমান্ডের প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে, এই দেশে এমন একটি ব্যবস্থাকে স্থায়ী হয়েছে যেখানে যোগ্যতা এবং প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উপেক্ষিত, পুরো সিস্টেম আগাগোড়া পক্ষপাতিত্ব আর নেপোটিজমের শিকার। তৈলবাজির রাজনীতিতে নিজ দল বা দলীয় নেতাদের সমালোচনা করা বা হালুয়া রুটির বন্দোবস্ত প্রথার স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা বা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন প্রস্তাব রাখার পরিবর্তে, সবাই দলীয় সিদ্ধান্তে “মারহাবা মারহাবা” শ্লোগান, আর নেতা-নেত্রীকে সেজদা করায় ব্যস্ত। সেজদাকারীদেরই নিজের লোক মনে করছেন দলীয় প্রধানরা, আনুগত্যের নামে পদলেহনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর এই প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনে চললেই পুরস্কার। সমালোচনাকারী যে আপন লোকও হতে পারে, সমালোচনা যে ভাবনার খোরাক দিতে পারে… তা এ অঞ্চলের মহান নেতা-নেত্রীরা ভুলতে বসেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো আজকাল মধ্যযুগীয় ধর্মের ন্যায় আচরণ করছে, দলের প্রধানরা ধর্মগুরু, খুলে বসেছেন দরগা মাজার, নেতাকর্মীরা সবাই পূজারী। ভিন্নমত পোষণ করলেই মহাশত্রু।
সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি প্রকৃত চিন্তাশীল নেতৃত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে, প্রগতিশীল কর্মী বাহিনী তৈরি করে, অথচ এ অঞ্চলে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ভিন্নমতকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং তৈলবাজ চাটুকারদের পুরস্কৃত করা হয়। প্রচলিত রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা বিরাজমান চাটুকারিতা বর্জন করে, দলীয় প্রান্তিককরণ বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস রাখে তারা দলীয় বিবেচনায় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে আজকাল, গাছের যেভাবে প্রুনিং করা হয় সেভাবে নিয়মিত তাদের কেটে বাদ দেয়া হচ্ছে পদ পদবী, ক্ষমতা থেকে। আশপাশে সবাই দেখছে দলীয় আবহে থেকে মুক্তচিন্তা আত্মহত্যার সামিল, নেতাকর্মীরা সেই কঠিন পথে না হেটে মারহাবা শ্লোগানে চাটুকারিতাই বেছে নিয়েছে। যা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চর্চাকে খর্ব করে সিন্ডিকেট গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করছে, সবাই লবিস্টদের জয়গান গাইছে, নেতাকর্মীরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক বক্তৃতার পুরোটা জুড়ে জয়গান গাইছেন মহান নেতা-নেত্রীদের, তোষামোদ করছেন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের। যেহেতু দল আর মার্কার নামে এক ধরণের বন্দোবস্ত প্রথা ইদানীং চালু হয়ে গেছে, সেহেতু জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তি পূজায় নিজের পকেটের কল্যাণের দিকেই নজর সবার, গোল্লায় যাক দেশ আর গণতান্ত্রিক চর্চা। রাজনীতিতে মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে ঘাগু চিন্তাশীল নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কাছে হারিয়েছেন আস্থা, সম্মানের অবস্থান। জয়ের শ্লোগানে যারা নেতাদের পেছনে মিছিল করছে, তারাও আদতে একই সংস্কৃতির চর্চায় নিজের ধান্দায় ব্যস্ত, আজ এই নেতা তো কাল ঐ নেতা, বাতাসের দিক পরিবর্তনে বদলাচ্ছে মিছিল শ্লোগানে নেতার নাম। এই ধরণের তোষামোদি সংস্কৃতি প্রকৃত মুক্তচিন্তার রাজনৈতিক চর্চাকে শুধুমাত্র নিরুৎসাহিত করে তাই নয় বরং এখানে সক্রিয়ভাবে দমন করা হয় ব্যক্তির সৃজনশীল চিন্তার প্রক্রিয়াকে, যেন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তির মগজের দখল নিয়ে বসে আছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক মিডিয়া কর্মীদের দলবাজি আর তোষামোদি। বক্তব্যধর্মী, চিন্তার খোরাক যোগায় এমন আলোচনা সমালোচনা ছেড়ে তারা একেকজন একেকটি দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ব্যক্তির পছন্দ ও অপছন্দ থাকতেই পারে, তা লেখালিখিতেও তার প্রভাব পড়ে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে যেভাবে নগ্ন চাটুকারিতায় লিপ্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট মিডিয়া কর্মী ও প্রভাবশালী সাংবাদিকবর্গ, তাতে মনে হচ্ছে তাঁরা মূলত দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন।
রাজনীতির এই অতি-দলীয়করণ প্রকৃতি দেশ ও সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা সহজেই অনুমেয়। নেতারা তাদের আশপাশে ইকো চেম্বার তৈরি করে রেখেছেন যেখানে সবসময় সমমনা পদলেহনকারী ব্যক্তিদের দ্বারা বেষ্টিত থাকেন এবং ভিন্নমতকে বাঁকা চোখে দেখেন। যা দু একজন রাজনৈতিক মুক্তচিন্তক নিজস্ব সৃজনশীলতায় বুদবুদের মত ভেসে উঠছেন, তাদের দমিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘরের শত্রু বিভীষণ আখ্যায়িত করে। খেয়াল করলে দেখবেন, আদতে এই দেশে ষাটের দশকের পরে আদতে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে দক্ষ ছাত্রনেতা তৈরি হয়নি, স্বাধীনতা উত্তর প্রায় সকল নেতাই চাটুকারিতায় পারদর্শী। ভেবে দেখুন, বয়োবৃদ্ধ শ্রদ্ধেয় নেতা, এখনো যাদের আমরা রাজনৈতিক মস্তিষ্ক হিসেবে জানি, তারা প্রায় সবাইই ষাটের দশকের প্রোডাক্ট। পরবর্তী সময়ে যেসব ছাত্রনেতাদের আমরা পেয়েছি, তারা সবাই ক্ষমতার সাথে আপোষ করে ক্ষমতাবানই হতে চেয়েছেন। ক্ষমতা চাই, তা যেভাবেই হোক, অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তি যে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হয়ে গেছে, সেখানে চাটুকারদের উর্বর ফলন হবে, প্রকৃত মুক্তচিন্তার রাজনীতিবিদদের আকাল তো থাকবেই।
ক্ষমতা এবং প্রভাবের রাজনীতির নিরলস সাধনা চলছে, নীতি নৈতিকতার সাথে আপস নেতাদের মানুষরূপী জানোয়ারে পরিণত করছে। নীতি এবং মূল্যবোধের উপর যখন স্বার্থ এবং সুবিধা প্রাধান্য পায়, তখন ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা অনুসরণে তাদের সততা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক হবে এটাই স্বাভাবিক। দু চারজন বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা মাঝে মধ্যে গাইগুই করেন, আদতে তারা সুবিধাবাদের কফিনে মোড়ানো চিন্তার জিন্দা লাশ। অথচ তারা পারতেন সমালোচক হয়ে যুক্তি দিতে, চিন্তার খোরাক দিতে, পারতেন রাজনৈতিক অঙ্গনের গণতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মুক্ত চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে। কয়েকজনের নাম তো আপনি মুখস্থ বলে দিতে পারবেন, যারা ব্যতিক্রম হতে পারতেন, কিন্তু বাস্তবতা হল তারা ব্যতিক্রম হতে চাননি। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন নীরবতার দাসত্ব।
পাঠকরা মনে রাখবেন, ব্যক্তির চাটুকারিতায় ব্যক্তি বা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু কলমের দাসত্বের দায় পুরো দেশ ও সমাজকে বয়ে নিতে হয় শতাব্দী পর্যন্ত।
তথাকথিত রাজনৈতিক আদর্শের বৃত্তে বন্দী থেকেও “মুক্তচিন্তা”র ধারণাটি মহৎ মনে হতে পারে, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আপাত দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক মুক্তচিন্তার মত বিষয়টিই মনে হচ্ছে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা বাস্তবে দুঃসাধ্যই বলা চলে। তোষামোদ সিন্ডিকেটের বলয়ে স্বার্থ এবং স্বজনপ্রীতির চরম চর্চায় দলীয় বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা পূজার বেদীতে বলি দেওয়া হয়েছে। এমন হয়তো অনেকেই ছিলেন, যারা রাজনৈতিক গণ্ডিতেও মুক্তচিন্তা করতে পারতেন, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন আত্মসম্মানবোধে, বিবেকের দহনে। যে রাজনীতি বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিবিদদের উপহার দেয়, তা হয়তো আমাদের আর প্রয়োজন নেই। সবাই আজকাল নিজেকে উজাড় করে ভক্তি-শ্রদ্ধা মিশনে নেমেছেন। প্রভুভক্তরা নেতা হচ্ছেন অদৃশ্য আঙ্গুলের ইশারায়, ভুলে গেলে চলবে না, প্রভুভক্ত কিন্তু কুকুরও হয়, জনগণের নেতা হতে যোগ্যতা লাগে। সৃজনশীল, মুক্তচিন্তক রাজনীতিবিদদের দিয়ে কি করবেন, উন্নয়ন তো হচ্ছে।
“মস্তিষ্ক, তুমি নত হও… তোমাকে বানাই ভাবনার বারবনিতা
কলম, তুমি আকন্ঠ পান কর কালের বীর্য… লিখে যাও আজ্ঞাবাহী আখ্যান!”
- ডা. এনামুল হক। চিকিৎসক ও কলামিস্ট।