নিজোর ঘরো না খাইয়া থাকলেও মন শান্তি থাকে
‘নিজোর ঘরো না খাইয়া থাকলেও মনো শান্তি থাকে। আর ঘর বাড়ী ছাড়া ঈদ করমু এবার ভাবতে খারাপ লাগে। ইবার (এবছর) ঈদ কাটবো আশ্রয় কেন্দ্রে। তাই এবার ঈদর আনন্দ নায় বরং খারাপ লাগবো বেশি। জীবনে কোনদিন আশ্রয় কেন্দ্রে ঈদ করছি না। ইবার বন্যায় আশ্রয় কেন্দ্রে ঈদ করতে হবে।’
কথাগুলো বলছিলেন কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ঘাটের বাজার বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা ষাটোর্ধ হাওয়া বিবি।
শুধু হাওয়া বিবিই নয়, কুলাউড়ায় বন্যায় আক্রান্ত আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বানভাসীদের মধ্যে পবিত্র ঈদ-উল আযহা কোনো আমেজ বা আনন্দ নেই। গত ২০ দিন থেকে পানিবন্দি হয়ে আত্মীয়ের বাড়ী বা আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন কুলাউড়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। আর আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ। ঈদের প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলে প্রায় সকলের কন্ঠে ঝরে অসহায়ত্বের কথা।
কুলাউড়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলেন সাড়ে সাত হাজার মানুষ। অনেকে ইতোমধ্যে ছেড়েছেন আশ্রয় কেন্দ্র। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। বন্যার পানি না কমায় ঈদের আগে তাদের বাড়ি ফেরা অনেকটা অনিশ্চিত।
ঈদ আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে বন্যার পানিবন্দি কুলাউড়ার লাখো মানুষের। এবারই প্রথম অনেকের ঈদ কাটবে কারো আশ্রয় কেন্দ্রে আবার কারো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। দীর্ঘ পানিবন্দি অবস্থায় দুর্ভোগে মানবেতর দিন কাটছে উপজেলার বন্যাপীড়িত অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষের।
জানা যায়, গত ১৭ জুন থেকে হাকালুকি তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার পৌর এলাকাসহ ভাটেরা, বরমচাল, ভূকশীমইল, কাদিপুর, ব্রাহ্মণবাজার ও জয়চন্ডী ইউনিয়নের ৭০ টি গ্রাম। সীমান্তের ওপার থেকে আসা এবং পাহাড়ী ঢল ও অতিবৃষ্টির প্রভাবে বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন।
প্রায় ২০ দিনে পানিবন্দি উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। পানি কমছে খুব ধীর গতিতে। এখনো ৫০ শতাংশ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গত তিন দিনে পানি না কমায় দুর্ভোগ আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। দুইদিন পরেই ঈদুল আযহা। বাড়িতে পানি থাকায় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও কোরবানী দিতে পারছেন না।
প্রতিবছর ঈদকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেন। এবারই প্রথম পানিতে প্লাবিত এলাকার নিম্ন, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ঈদের সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে। ঈদের দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের বাড়ি ফেরার ব্যাকুলতা আর আর হতাশায় কাটবে।
কুলাউড়া পৌরসভার বিএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মনসুর গ্রামের হালিমা খাতুন বলেন, ‘এইবার ঈদ কাটবে আশ্রয়কেন্দ্রে। ইতা কোন সময় কল্পনাও করিনি। নিজেরা কোরবানী দিতে না পারলেও গ্রামে আমাদের সচ্ছল প্রতিবেশীরা কোরবানী দেন। পানি থাকায় এবার তারাও কোরবানী দিবে না। বাচ্চারা এইবার কোরবানীর মাংস খেতে পারবে না। সারাদিন কাটবে আশ্রয় কেন্দ্রের বদ্ধঘরে।’
শ্রীপুর কামিল মাদরাসা বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আব্দুল কাইয়ুম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রোজিনা, সুলতানা জানান, ‘আমরা বাড়িতে ফিরতে চাই। আমাদের ফেরার ব্যবস্থা করে দিন।’
কুলাউড়ার বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী জানান, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদের দিন কোরবানীর গরুর গোশত ও রান্না করা খাবার বিতরণ করবে বিভিন্ন সংস্থা। সরকার থেকে যেসব বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে, তা ইতোমধ্যে বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। তারপরও ঈদের দিনে এসব অসহায় মানুষকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করবো।’
শুধু কুলাউড়াতেই নয়, সিলেটেও ২১ হাজারেরও বেশি বানভাসি মানুষ এবার আশ্রয়কেন্দ্রেই ঈদুল আযহা পালন করবে। তাদের ঈদ আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে স্মরণকালের বন্যা।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী এবারের বন্যায় সিলেটের ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবারের ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ২৯৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন ২১ হাজার ৬২৪ জন। ঈদের আগের আগের দিন আরও কিছু বানভাসি তাদের বাড়িতে ফিরলেও আশ্রয়কেন্দ্রে আনন্দবিহীন ঈদ কাটাবে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।