বই উৎসবের বাকি আর ১৪ দিন। অন্য বছর এ সময়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নতুন বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন পর্যন্ত উপজেলায় পৌঁছেছে মাধ্যমিকের ৫০ শতাংশ বই। প্রাথমিকে সেটা মাত্র ১০ শতাংশ। কাগজ সংকটের অজুহাতে বিভিন্ন উপজেলায় আবার পাঠানো হচ্ছে নিম্নমানের বই। এসব বই সরবরাহ করায় গত কয়েকদিনে আট প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক বই ও কাগজ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে এনসিটিবি। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ১০ কোটি পাঠ্যবই রয়েছে। গত মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত প্রায় ১৭ কোটি বই ছেপে উপজেলা পর্যায়ে পাঠিয়েছেন ছাপাখানা মালিকরা। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর ১৪ দিন। এই সময়ে আরও ১০-১২ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। ১ জানুয়ারির আগে পর্যন্ত অন্তত ৮০ শতাংশ বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ চলছে। কাগজ-গ্যাস ও ছাপার জন্য কালিসহ অন্যান্য জিনিসের সংকটের অজুহাতে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে নিম্নমানের বই।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে হাওলাদার, আলামীন, মেরাজ, আমীন, সরকার আফসেট প্রেসসহ সাতটি ছাপাখানার নিম্নমানের বই চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করা হয়েছে। কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্সে পাঠ্যবই ছাপার জন্য আনা কয়েক টন নিম্নমানের কাগজ শনাক্ত করে সেগুলো বাতিল ও সতর্ক করেছে এনসিটিবি।
তবে ব্রাইট প্রিটিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী তার নিজস্ব একাধিক প্রেসের নামে এবার প্রায় ৭০ কোটি টাকার কাজ নিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি এনসিটিবির সর্বোচ্চ কাজ পান। এবার তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কাজ করছেন। তার প্রতিষ্ঠান থেকে এবার নিম্নমানের কাগজে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় বই সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। রহস্যজনকভাবে এনসিটিবি ও মান যাচাইকারী ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠান বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, গত বছর যারা নিম্নমানের বই তৈরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এনসিটিবি তাদের বিশেষ অনুমোদন দিয়ে সেসব বই অনুমোদন দিয়েছে। কয়েকজনকে জরিমানা করছে। জরিমানার সাধারণত শর্ত অনুযায়ী বই খারাপ হলে সেগুলো রিপ্লেস করে দেওয়া হয়। তাই কোথায় কোথায় খারাপ সেটি জানতে মুদ্রণ সমিতি থেকে চিঠি দেওয়া হয়। যারা নিম্নমানের বই দিয়েছে তাদের নামে এনসিটিবিতে আমরা ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। অধিক মুনাফার আশায় অনেকে এই পথ বেছে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে এনসিটিবির বইয়ের জন্য ভার্জিন পাল্প প্রয়োজন, সেটি বাজারে নেই। রিসাইকেল পাল্প দিয়ে তৈরি কাগজে বই তৈরি করা হচ্ছে। এতে কমে গেছে ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা)। নানাভাবে ব্যবহৃত বই-খাতা ও কাগজ দিয়ে রিসাইকেল পাল্প তৈরি করা হচ্ছে। সে কারণে ভালো মানের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেসের পরিবর্তে ৮২ শতাংশ দিয়ে বই তৈরির অনুমোদন দিয়েছে এনসিটিবি। সেই সুযোগে অনেকে খারাপ কাগজে বই বানাচ্ছে। কাগজ মিলগুলো টাকা নিয়ে এখন কাগজ দিচ্ছে না। কাগজ নিশ্চিত করতে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তার কাছে সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
তোফায়েল খান আরও বলেন, কাগজ সংকট সমাধানে শিক্ষামন্ত্রী মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে চাইলেও তারা আসছে না। কাগজ পাওয়া গেলে বই ছাপার কাজ আরও দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে। আগামী বছর মাধ্যমিকের ৬০ শতাংশ আর প্রাথমিকের ৩০ শতাংশ বই পাঠানো হতে পারে। তবে কয়েকটি বড় প্রেস নিম্নমানের কাগজ দিয়ে প্রাথমিকের বিপুল সংখ্যক বই তৈরি করে গোডাউনে রেখেছে। জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করে সেসব বই নিতে সরকারকে বাধ্য করতে এমন কাজ করা হচ্ছে।
এনসিটিবির বিতরণ শাখা থেকে জানা যায়, গত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। তার মধ্যে মাধ্যমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১৫ কোটি, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির দুই কোটি কপি বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। মাধ্যমিকের ৫০ শতাংশ বই তৈরি হওয়ায় বর্তমানে প্রাথমিকের বই ছাপানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে মাধ্যমিকের বই তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘মাধ্যমিকের প্রায় ৬০ শতাংশ বই চলে গেছে (উপজেলায়)। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। বর্তমানে আমরা প্রাথমিকের বই তৈরির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যেহেতু আমাদের কাগজ সংকট রয়েছে, সে কারণে পুরোনো বই, খাতা ও ব্যবহারের কাগজ দিয়ে রিসাইকেল পাল্প ব্যবহার করা হচ্ছে। ভার্জিন পাল্প না থাকায় এ পথ বেছে নিতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই সুযোগ নিয়ে কেউ নিম্নমানের কাগজে বই দেওয়ার চেষ্টা করলে তা গ্রহণ করা হবে না। এ অভিযোগে সাতটি ছাপাখানার বই নষ্ট করা হয়েছে। একটি প্রেসের কাগজ বাতিল করা হয়েছে। আগের চেয়ে আমাদের মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে আমাদের হাতে যে সময় আছে তার মধ্যে সারাদেশে মোট বইয়ের ৮০ শতাংশ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
সূত্র : জাগো নিউজ