‘তারা আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়। একজন অফিসার আমার পিঠে তার বুট রাখে। সে আমার পেটে লাথি মারে, হাত বেঁধে ফেলে, আমাকে তুলে নিয়ে একটি ভ্যানে উঠিয়ে দেয়।’ এভাবেই নিজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন গত সপ্তাহে তেহরানে গ্রেফতার হওয়া একজন বিক্ষোভকারী।
নিরাপত্তা হেফাজতে মাহশা আমিনি নিহতের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গ্রেফতার হন মরিয়ম (ছদ্মনাম) নামের ৫১ বছরের এই বিক্ষোভকারী।
মাহশা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের অবসানের দাবিতে মূলত নারীদের নেতৃত্বে ইরানের এবারের বিক্ষোভের সূত্রপাত। কিন্তু এক পর্যায়ে রাজপথের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তেহরানের রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ‘স্বৈরশাসক নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন আন্দোলনকারীরা।
দেশজুড়ে বিক্ষোভের বাস্তবতায় ইরানে ইন্টারনেট সংযোগেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতারের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করা অব্যাহত রয়েছে। মরিয়ম বলছিলেন, ‘আপনি এই ভিডিওগুলিতে যা দেখছেন পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ।’
তার ভাষায়, ‘একজন কমান্ডারকে সেনাদের নির্দয় হওয়ার নির্দেশ দিতে শুনেছি। নারী অফিসাররা ভয়ঙ্কর। তাদের একজন আমাকে চড় মেরেছে। আমাকে ইসরায়েলি গুপ্তচর ও যৌনকর্মী বলেছে।’
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কমান্ডাররা দাঙ্গা পুলিশকে ‘বিক্ষোভকারীদের প্রতি দয়া না দেখিয়ে তাদের গুলি করার’ নির্দেশ দিচ্ছেন। বিবিসি কর্তৃক যাচাইকৃত অন্যান্য ভিডিওতে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করছে এবং ধরতে পারলে গ্রেফতার করছে।
ইরানের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক অস্থিরতা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪১। তাদের বেশিরভাগই বিক্ষোভকারী হলেও নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যও রয়েছে। তবে ২৬ সেপ্টেম্বর অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) জানিয়েছে, চলমান বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭৬ জন নিহত হয়েছে। চলমান ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ফলে সব জায়গায় আলাদা করে হতাহতের ঘটনা নিশ্চিত করা কঠিন বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
চলমান বিক্ষোভে এ পর্যন্ত ঠিক কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; সে ব্যাপারে তেহরানের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে তেহরানের উত্তরে অবস্থিত মাজানদারান প্রদেশের প্রধান প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, সেখানেই অন্তত ৪৫০ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দেশটিতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে আটক করা হচ্ছে।
বড় একটি শহরে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া স্যাম নামের একজন তরুণ প্রতিবাদকারী বলেন, ‘আমি একজন নিরাপত্তা অফিসারকে পিছনে ঠেলে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু দ্রুত সেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় একজন এসে পৌঁছায়। কয়েক সেকেন্ড পর ১৫ জনেরও বেশি এজেন্ট আমাকে নির্মমভাবে মারধর করে।’
স্যাম বলেন, ‘মুখে রক্তের গন্ধ এবং শরীরে ইলেক্ট্রিক স্টান গানের আঘাত অনুভব করেছি। তারা আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়। পিঠের পিছনে হাত বেঁধে দেয়। জুতোর ফিতা দিয়ে পা বেঁধে ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘অন্য বন্দিদের সঙ্গে রাখার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন সেনাসদস্য আমার বাম চোখে লাথি মারে।’
স্যাম বলেন, ‘তারা আমাকে এবং অন্যান্য বন্দিদের একটি বাসের মেঝেতে পরস্পরের ওপর দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত রেখেছিল। আমি রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাইসির ভূমিকার কথা ভাবছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছিলাম যে, তারা আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে।’
দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ পরিকল্পিতভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে ফিরে তিনি বলেছিলেন, স্বাভাবিক বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া উচিত, তবে সহিংসতা মেনে নেওয়া হবে না। তার এমন হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেই বিক্ষোভ এখন ইরানের ৩১টি প্রদেশের বেশিরভাগগুলোতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
অনেক ইরানিদের কাছে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ১৯৮০-এর দশকে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। ওই সময়ে গোপন ট্রাইব্যুনালে বসে লোকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া চারজন বিচারকের একজন ছিলেন তিনি।
রাইসি বলছেন, ১৯৮০-এর দশকে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল তারা ইরানের আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। তবে এবার তিনি বিক্ষোভে জড়িত ব্যক্তিদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, এমন কোনও প্রমাণ নেই।
মরিয়ম বলছিলেন, তাদের যখন বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর হেফাজতে স্থানান্তর করা হয় তখন তার পাশে থাকা অন্য আটককৃতরা প্রতিবাদ করছিলেন।
মরিয়ম জানান, ভ্যানে তার সঙ্গে অন্য মেয়েরাও ছিল। কিন্তু তারা অনেক কম বয়সী ছিল। তাদের সাহসিকতা মরিয়মকে মুগ্ধ করে। তার ভাষায়, ‘তারা চিৎকার করছিল এবং অফিসারদের নিয়ে মজা করছিল। এই প্রজন্ম আমার প্রজন্ম থেকে আলাদা। তারা নির্ভীক।’
বিবিসি কর্তৃক যাচাইকৃত ছবি এবং ভিডিওতে দেখা গেছে, গ্রেফতারকৃত বিক্ষোভকারীদের স্বজনরা উত্তর তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারের সামনে জড়ো হয়েছে। তারা আটককৃতদের সম্পর্কে তথ্য জানার বা তাদের জামিনের জন্য নথি জমা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
একজন ব্যক্তি বিবিসিকে বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতারের কথা প্রচার না করতে কর্তৃপক্ষ তাদের সতর্ক করে দিয়েছে। অন্যথায় ‘তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে’ বলেও জানিয়েছে তারা। সূত্র: বিবিসি।