সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজ। এমসি কলেজ নামে পরিচিত তৎকালীন আসাম প্রদেশের একমাত্র এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করেছেন দেশবরেণ্য অনেক গুণীজন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এম সাইফুর রহমান। বাংলাদেশের উন্নয়নের এই বরপুত্র ২০০৯ সালের আজকের দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। কিংবদন্তী এই রাজনীতিবিদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
সিলেটের টিলাগড় এলাকায় থাকা ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এমসি কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে আইএ পাশ করেন বিশ্ববরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ। ‘সিলেটপ্রেমী’ হিসেবে খ্যাত সাইফুর রহমানের জীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর তৎকালীন সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা আব্দুল বাছিত এবং মাতা তালেবুননেসা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সাইফুর রহমান।প্রখর মেধা শক্তির অধিকারী সাইফুর রহমান, মৌলভীবাজার সরকারি স্কুল থেকে লেখাপড়ার পর দি এইডেড হাই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।
পরবর্তীতে সিলেটের এমসি কলেজে ভর্তি হন। ১৪৪ একরের এমসি কলেজের সবুজ আঙিনায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটান সাবেক এই সফল অর্থমন্ত্রী। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে শতবর্ষী এই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করেন। এরপর ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাইফুর রহমান রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হক ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস (আইসিএইডাব্লিউ) হতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিএ) বিষয়ে উচ্চতর ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে যোগ দেন যার কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানের করাচিতে। তবে সে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় এসে ১৯৬২ সালে দুই সহকর্মীকে নিয়ে ‘রহমান রহমান হক অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি অডিট ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা এখনো দেশের অন্যতম চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে ১৯৬৯ সালে একমাত্র সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন সাইফুর রহমান। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যও ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করলে ১৯৭৬ সালে তিনি এ সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্ঠা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে ১৯৭৭ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে টেকনোক্র্যাট কোটায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সাইফুর রহমান।
বিশ্ববরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ১৯৯৪ সালে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগে, ১৯৮০-১৯৮২ ও ১৯৯১-১৯৯৬ পরপর দুই মেয়াদে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফএডিতে বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন এই কিংবদন্তি। ১৯৯৪-১৯৯৫ মেয়াদে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
দেশপ্রেমী সাইফুর রহমান তার মেধায় অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উত্তোরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যান। তার নেতৃত্বেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়। বাংলাদেশে ভ্যাট প্রথার প্রবর্তকও ছিলেন সিলেটের সন্তান সাইফুর রহমান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এম সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশের ইতিহাসে প্রথম সর্বোচ্চ ১২বার বাজেট পেশ করার রেকর্ড গড়েন। এমসি কলেজের এই সাবেক শিক্ষার্থী জীবনের শেষ জুম্মার নামাজ সিলেট নগরীর বন্দরবাজার জামে মসজিদে আদায় করেছিলেন। জীবনের শেষ জুম্মায় উপস্থিত মুসল্লীদের সামনে সাবেক এই সফল অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন , ‘যত দিন বেঁচে থাকব সিলেটকে নিয়েই বাঁচতে চাই-সিলেটই আমার শেষ ঠিকানা।’
আশরাফ আহমেদ
সাবেক সভাপতি : এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি