জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উজানে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভবিষ্যতেও বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়বে। ফলে আগামী বছরগুলোতেও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। সঙ্গত কারণে এসব বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজানো উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমাদের নদীগুলো উজান থেকে আসা পানি ধরে রাখার মতো অবস্থায় নেই। নদী খনন ছাড়াও বাঁধ নির্মাণ করে মানুষের আবাসস্থল এবং ফসলি জমি আলাদা করার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা।
গত বছরের জুন মাসে দেশে মোট বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২৭১ মিলিমিটার। যা চলতি মাসের ২৭ জুন পর্যন্ত হিসেবে ১৬ হাজার ১০৮ মিলিমিটার। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, এই সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮ হাজার ৯০৮ মিলিমিটার। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত বৃষ্টি কম হলেও আগামী কয়েকদিন ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ফলে এই বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। চলতি বছর ভারতের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সিলেট, সুনামগঞ্জ ছাড়াও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে অসময়ে পানিবন্দি সাধারণ মানুষ।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, চলতি বছর এখন পর্যন্ত যে বৃষ্টি হয়েছে তা স্বাভাবিক। গত বছরের তুলনায় এখনও কম। তবে আগামী কয়েকদিনে এই বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। এতে গতবছরের তুলনায় প্রায় সমান অথবা বেশি হতে পারে।
চলতি বছর সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। দেশের মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলেও পরপর দুই দফা সিলেটের মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টির মূল কারণ উজানের ঢল। মূলত উজানে বেশি বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি ভাটিতে গড়ানো স্বাভাবিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন কেন এই বন্যার সৃষ্টি হলো কেন মানুষের বাড়িঘর তলিয়ে গেল সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এটা করা গেলে কিভাবে ভবিষ্যতে বন্যা প্রতিরোধ করা যায় সে পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে উজানে বৃষ্টি আরও বাড়বে। এখন যে বন্যা হচ্ছে তা তো দেশের ভেতরের বৃষ্টির জন্য হয়নি। উজানে বিশেষ করে চেরাপুঞ্জিতে প্রবল বৃষ্টিপাত এর কারণ। ফলে উজানে যদি ভবিষ্যতে বৃষ্টি বাড়ে তাহলে দেশের মধ্যে অল্প বৃষ্টি হলেও বন্যা হতে পারে। সুতরাং শুধু বৃষ্টি নয়, এই বন্যা ঠেকাতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে।
তিনি বলেন, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে কিভাবে বাঁধ দিয়ে শহর রক্ষা করা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষায় নদী কানায় কানায় ভরবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি শহরে ঢুকে পড়ে সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব প্রকৃতির নয়, মানুষের। মানুষকে আগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস বিবেচনা করা বন্যার কথা ভেবেই পরিকল্পনা করতে হবে। তিনি বলেন, চেরাপুঞ্জিতে পুরো মাসে যে বৃষ্টি হতো, চলতি মাসে তিন দিনেই বৃষ্টি হয়েছে ২০০০ মিলিমিটার। যা এর আগে কখনও হয়নি।
দক্ষিণ-পশ্চিমা মৌসুমি বায়ু এখন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষা শুরু হয়, সেই বায়ু এখন সারাদেশে প্রভাব বিস্তার করছে। আর এ কারণে ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও হালকা আবার মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে এবার আষাঢ় আসার অনেক আগেই মৌসুমি বায়ু দেশে প্রবেশ করেছে। গত ৪ জুন (২১ জ্যৈষ্ঠ) মৌসুমি বায়ু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে গত বছর ৫ মাস বৃষ্টি ঝরিয়ে মৌসুমি বায়ু বিদায় নেয়। গতবছরের জুনে টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ু দেশের ওপর দিয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সেটা ২২ অক্টোবর পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়। এবারও এমন আবহাওয়া থাকবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উজানে যেমন বৃষ্টির ধরণ বদলেছে, বাংলাদেশেও বদলেছে। আগে যে সময়ে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে আসতো গত কয়েক বছরে সে সময় এগিয়ে এসেছে। অন্যদিকে চলে যাবার সময়ও এখন দেরিতে হচ্ছে। এতে দেশে এখন ছয় ঋতুর দেখা পাওয়াই যাচ্ছে না। এটা শুধু বন্যার জন্য নয়, পুরো ইকোসিস্টেমের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমনকি ফুড চেইনেও এর প্রভাব আছে। তিনি বলেন, গত ১০০ বছরের বৃষ্টির ধরণ দেখলে বোঝা যায় কি পরিমাণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনটাই আমাদের জীবনে বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন