বিগত তিনটি নির্বাচনে ভারতের ভূমিকায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা সংক্ষুব্ধ। কিন্তু দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তার গায়ে থাকা ভারতের তৈরি চাদর ছুড়ে ফেলে দিয়ে যে প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ করেছেন তার সঙ্গে একমত নন দলটির নীতি-নির্ধারকরা। তাদের মতে, বিএনপি ভারতের পণ্য বর্জনের মতো আন্দোলনে যুক্ত হলেও তা আরও পরিশীলিতভাবে করা যায়। কিন্তু চাদর ছুড়ে ফেলে দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে তাতে আগুন ধরানোর ঘটনা কিছুটা ‘স্থূল’ পর্যায়ের কর্মকাণ্ড হয়েছে। যার সঙ্গে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হতে পারে না।
তবে কৌশলগত কারণে বিএনপিতে ভারতপন্থি বলে পরিচিত নেতারা এ বিষয়ে খুব বেশি কথা তুলতেও পারছেন না। তারা এখন বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলের মধ্যে ভারতবিরোধিতা অনেকাংশে বেড়েছে। এমনকি দলের হাইকমান্ডও ভারতের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। ফলে রিজভী সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে ওই ঘটনা ঘটালেও এ বিষয়ে তাকে কিছু না বলে নীরব থাকতে পারে বিএনপি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের চাদর ফেলে দিয়ে আন্দোলনে নামার নির্দেশনা বিএনপির হাইকমান্ড রিজভীকে দেয়নি। একইভাবে রিজভীর এই ভূমিকা নিয়ে দল তাকে কিছু বলবেও না। কারণ দলের ভেতরে ও বাইরে ভারতবিরোধী মনোভাব এখন বেশ প্রবল।
জানা গেছে, গত বুধবার রিজভীর ওই চাদর ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় বিএনপির মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ বলছেন, রিজভী ঠিকই করেছেন। কারণ, ভারত কখনই বিএনপিকে কোনো ‘স্পেস’ দেবে না। তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্যই ভূমিকা পালন করবে। আবার কারও মতে, ভারতের মতো বৃহৎ প্রতিবেশী একটি দেশের বিরুদ্ধে ওইভাবে রাস্তায় নেমে ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন করা ঠিক হয়নি। তাদের মতে, ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান তৈরি করতে হলে সেটি সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে এবং আরও সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া যেত। কিন্তু রিজভী যা করেছেন সেটি বিএনপির মতো বড় একটি দলের পক্ষে বেমানান।
উল্লেখ্য, রুহুল কবির রিজভী দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ছাড়াও দলের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি দলের মুখপাত্র নন। মুখপাত্র হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছাড়াও দলের দুর্দিনে হাইকমান্ডের নির্দেশনায় গণমাধ্যমে কথা বলেন রিজভী। অনেক ক্ষেত্রে তিনি তারেক রহমানের নির্দেশনায় প্রেস ব্রিফিং করেন। আবার কখনো কখনো নিজ উদ্যোগে ইস্যুভিত্তিক কথা বলে গণমাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে রিজভী নিজ উদ্যোগে, নাকি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় ভারতবিরোধী ওই অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তা নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি আছে কি না, তা নিয়ে গতকাল দিনভর বিএনপির মধ্যে নানা আলোচনা হয়েছে। তবে স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সরাসরি মুখ খুলতে রাজি হননি। কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই রিজভীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চাদর ছুড়ে ফেলার বিষয়ে রিজভী গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটি দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। নিজের একান্ত ভাবনা থেকে তিনি এ কাজটি করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে রিজভীর ভূমিকার বিষয়টি তারা তুলবেন। তিনি জানান, স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ।
অবশ্য অন্য একজন নেতা বলেন, ভারতের ভূমিকায় বিএনপি ক্ষুব্ধ ও হতাশ। নেতা-কর্মীরা এখন প্রচণ্ড ভারতবিরোধী অবস্থানে আছেন। তবে রিজভী প্রকাশ্যে ওইভাবে এটি না করলেও পারতেন। ওই নেতার সন্দেহ, তারেক রহমানকে খুশি করার জন্য অতি উৎসাহী হয়ে রিজভী ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইনে সরব হয়ে থাকতে পারেন।
গত বছরের ২ জানুয়ারি এক ভিডিওবার্তায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন।
এর আগে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশে একটি স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক এবং দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, যা ১৮ কোটি মানুষের স্বার্থবিরোধী। ভারত, চীন, রাশিয়ার ভূমিকা গণতন্ত্র পরিপন্থী। তবে গত ১৮ মার্চ সোমবার তিনি বলেছেন, ‘বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আমরা দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীন করতে পেরেছি। আজকে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারেও আমরা বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করছি।’ মঈন খানের বক্তব্যের মাত্র দুই দিন পরে রিজভীর চাদর ফেলে দেওয়ার ঘটনাকে অনেকে ‘সাংঘর্ষিক’ বলেও মনে করেন।
তবে দলের সর্বস্তরে যে ভারতবিরোধিতা ছড়িয়ে পড়েছে তা দল্যের অন্য নেতাদের বক্তব্যে ইদানীং স্পষ্ট হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই সরকার জনগণের নয়। তারা ভারত, চীন, রাশিয়ার সরকার। তাই আমরা এই সরকারকে মানতে বাধ্য নই।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ-থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপির এই অবস্থানের বিষয়ে জোটের বৈঠকে আলোচনা করে তার মন্তব্য জানাতে পারবেন।
সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনায় সব সময় সরব থাকেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, গত ৩টি নির্বাচনে জনমতের বিপক্ষে গিয়ে ভারত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন দিয়ে কার্যত বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যেখানে গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়েছে সেখানে ভারত বর্তমান একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ স্পষ্ট মনে করছে তাদের ভোটাধিকারের পথে ভারত অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জনগণ ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশ থেকেও ইন্ডিয়া হঠানোর দাবি উঠছে।
বিএনপি নেতা রিজভীর ভারতের চাদর ফেলা দেওয়ার ঘটনাকে অত্যন্ত সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন নুর। তার মতে, এর ফলে ভারতবিরোধী আন্দোলন আরও গতি পাবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার আমরা বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক চাই, তবে সে সুসম্পর্ক হতে হবে দুই দেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে।’
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির মধ্যে কম-বেশি আলোচনা ছিল যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করছে ভারত। কিন্তু তখন পর্যন্ত ওই আলোচনা এতটা তীব্র ছিল না। তবে ওই সময় থেকেই দলটির নীতি-নির্ধারকরা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হয়। পরবর্তী সময়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ওই নির্বাচনেও ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়েই কাজ করেছে। তার পরও বিভিন্ন বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায় বিএনপির হাইকমান্ড। ‘একতরফা’ ওই নির্বাচনের পর দলের পক্ষ থেকে একাধিক প্রতিনিধিদল দেশটিতে সফরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়।
এরপর, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে-পরে ভারতের নিরাপত্তার হুমকি হবে এমন কোনো কিছু হবে না জানিয়ে লন্ডন থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারকদের জানানো হয়। এ ছাড়া নানাভাবে ভারতের মন জয়ের চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিষয়ে নরম সুর দেখায় দলটি। যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, সে রকমই চেয়েছিল বিএনপি। তবে সেই ইতিবাচক অবস্থানেও যেন মন গলাতে পারেনি দলটি। তাই বিএনপি এখন মনে করছে, ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কোনো লাভের ফসল ঘরে তোলা যাবে না। ফলে দলটির মধ্যে ভারতবিরোধিতা ক্রমাগত বাড়ছে। রুহুল কবির রিজভীর কর্মকাণ্ড এরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : খবরের কাগজ