প্রাকৃতিক নৈসর্গের লীলাভূমি খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি দেশেই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের আয় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। কমলগঞ্জের পর্যটন শিল্পকে আকর্ষণীয় ও উন্নত করে তুলতে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।পর্যটনে সমৃদ্ধময় কমলগঞ্জ উপজেলা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য পর্যটন শিল্পের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশ ও বিদেশী পর্যটকদের কাছে কমলগঞ্জের পর্যটণ শিল্পকে কিভাবে আরও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা যায় সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটনে আমাদের কোন খাতটি দুর্বল তাও চিহ্নিত হবে।
সরকারীভাবে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর যথাযথ উন্নয়ন করা সম্ভব হলে বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করা সহজ হবে।সেই সাথে রাজস্ব আয়ও বাড়বে,হবে কর্মসংস্থান।
কমলগঞ্জের অন্যতম আকর্শনীয় স্থান সমূহঃ
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানঃ
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি নমুনা।এটি রেইন ফরেষ্ট নামেও খ্যাত। এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়ছড়া জাতীয় উদ্যান অন্যতম।
এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সূর্যের আলোর জন্য প্রতিযোগিতা করে এ বনের গাছপালা খুব উঁচু উঁচু এবং অনেক ওপরে ডালপালা ছড়িয়ে আছে। এই বন এতই ঘন যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়েনা বললেই চলে।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ১২৫০হেক্টর আয়তনের বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই বনকে বাংলাদেশ সরকার ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করে। উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। উল্লূক ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু।
মনোমগ্ধকর মাবধপুর লেকঃ
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের মাধবপুর চা বাগানে লেকটির অবস্থান। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা চা গাছের চারায় সেচ দেওয়ার জন্য সেখানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকায় এবং সেচ দেওয়ার পাশাপাশি সে পানিতে তারা স্পীড বোট ও নৌকা চড়তো বলে জানাযায়।বর্তমানে লেকটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।মাধবপুর লেকের ঝলমল পানি, ছায়াসুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি পর্যটকদের মনোমগ্ধকর করে তুলে।
চারদিকে সবুজ পাহাড়। পাশাপাশি উঁচু উঁচু টিলা। সমতল চা বাগানে গাছের সারি। মাধবপুর লেক যেন প্রকৃতির নিজ হাতে অঙ্কিত মায়াবী নৈসর্গিক দৃশ্য। সুনীল আকাশ আর গাঢ় সবুজ পাহাড়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত চা বাগানের এই মনোরম দৃশ্য আকর্ষন করে নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে।
দশটি বাঁক নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ভেতর তার চলা। শীতকালে অতিথি পাখির দল আসে এই লেকে। লেকের জলে গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে নীল শাপলা।লেকের দুই পাশে টিলায় টিলায় ছড়ানো চায়ের গাছ।এযেন প্রকৃতির এক মায়াবী রূপ।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধঃ
দেশমাতৃকার মুক্তির পথে জীবনদানের গল্প আঁকড়ে আছে এই স্মৃতিসৌধ। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ নেই কোন কোলাহল। চা বাগানের পরম মমতায় আগলে রেখেছে স্মৃতিসৌধকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানে স্থানীয় ও বিদেশী পর্যটকরা শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পাশাপাশি ঘুরে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য হামিদুর রহমানকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদান করা হয়।পাশেই স্থাপন করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান’স্মৃতি আর্কাইভ ।
এখানে প্রদর্শিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের ছোটবেলার ছবি, রয়েছে তার পারিবারিক ছবি। স্মৃতিসৌধের একদিকে বিজিবি ক্যাম্প, অন্যদিকে চা-বাগান। দক্ষিণে রয়েছে ভারতের ত্রীপুরা সীমান্ত।
হামহাম জলপ্রপাতঃ
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের দৃষ্টিনন্দন স্থানের মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের অন্যতম একটি স্থান হচ্ছে হামহাম জলপ্রপাত বা চিতা ঝর্ণা।এটি একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা।
জলপ্রপাতটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন।দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝরণাটি ১৩৫,মতান্তরে ১৪৭ কিংবা ১৭০ ফুট উঁচু, যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ঝরণা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা (১২ অক্টোবর ১৯৯৯-এর হিসাব অনুযায়ী)১৬২ ফুট।তবে ঝরণার উচ্চতা বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত কিংবা পরীক্ষিত মত নেই।সবই পর্যটকদের অনুমান। তবে গবেষকদের মতে এর ব্যাপ্তি, মাধবকুণ্ডের ব্যাপ্তির প্রায় তিনগুণ বড়।
ঝরণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচন্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝরণাধারায় এসে ঠেকে। ঝরণার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝরণার কাছে পৌঁছতে হয়। ঝরণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি, সাধারণত স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে পর্যটকরা ঝরণা ভ্রমণ করেন।
তাছাড়া ঝরণাকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো সরকারি অবকাঠামোও।তবে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে প্রচুর রাজস্ব আদায় হতো বলে স্থানীয়দের মত।
দৃষ্টিনন্দন ক্যামেলিয়া লেকঃ
চারদিকে সারি সারি চা বাগান আর ছোট-বড় পাহাড়ি টিলা। ওপরে নীল আকাশ। সব সময়ই আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি (স্থানীয়দের ভাষায় অতিথি পাখি)। এরই মাঝে অবস্থিত এক দৃষ্টিনন্দন লেক। চা বাগানের শ্রমিকদের কাছে এ লেকটি ‘বিসলার বান’ বা ‘ক্যামেলিয়া বাঁধ’ নামে পরিচিত। তবে এর প্রকৃত নাম ‘ক্যামেলিয়া লেক’। দৃষ্টিনন্দন এ লেকটির অবস্থান কমলগঞ্জ উপজেলার ‘ডানকান ব্রাদার্স টি এস্টেট’র শমসেরনগর চা বাগানে।
চা বাগানগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য প্রায় সব বাগানেই ছোট-বড় লেক দেখতে পাওয়া যায়। এসব বাগানের লেকগুলো সাধারণত চা বাগানের নিচু জমিতে বা পাহাড়ি টিলার পাদদেশে হয়ে থাকে। কিন্তু ক্যামেলিয়া লেকের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি বাগানের প্রায় শেষ প্রান্তে টিলার উপরাংশজুড়ে অবস্থিত।‘বিসলার বান’ বা ‘ক্যামেলিয়া লেক’টি পর্যটকদের স্বর্গোদ্যান হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত।
এখানে যেতে শমসেরনগর-চাতলাপুর চেকপোস্ট সড়ক ধরে দক্ষিণ দিকে প্রায় ২ কিলোমিটার সামনে গেলেই হাতের ডানে দেখা মেলে চা বাগানের শ্রমিক ও আশপাশের হাজারও জনসংখ্যার নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ক্যামেলিয়া হাসপাতালের। হাসপাতালটিকে পেছনে রেখে আরও ২ কিলোমিটার মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলবে এই প্রকৃতির নিজ হাতে তৈরি করা অপরূপ ও চোখ ধাঁধানো মায়াবী লেকটির। পর্যটকদের কাছে সৌন্দর্য মুগ্ধতা জাগানিয়া ক্যামেলিয়া লেক।
পদ্মছড়া লেকঃ
পর্যটনে বিপুল সম্ভাবনাময় কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুনভাবে যুক্ত হওয়া পর্যটকদের আকর্ষণ কাড়ে ‘পদ্মছড়া লেক’। কমলগঞ্জের অপরূপা এই লেকটি এখন বিনোদনের অন্যতম স্থান। বছরের যে কোনো মৌসুমেই পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারেন পদ্মছড়া লেকে। তবে এখনো দেশের অনেকের কাছেই অচেনা-অজানা এই ‘পদ্মছড়া লেকটি’। কৃত্রিম এ লেকটি পাহাড়ের বুক চিড়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের মাঝে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে।
এখানে এলে দেখা যায় সবুজের সমারোহ, সবুজ পাতার গন্ধ। পলকেই আপনার মনকে চাঙ্গা করে তুলবে এই প্রকৃতি। আপনি বিমোহিত হয়ে মিলিয়ে যাবেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে। লেকের পানি, সুনীল আকাশ আর গাঢ় সবুজ পাহাড়, ছবির মতো চা বাগানের এই মনোরম দৃশ্য আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের জগতে।
এছাড়াও অতিথি পাখির অভয়াশ্রম পাত্রখোলা লেক, লাউয়াছড়া স্টুডেন্ট ডরমিটরি লেকসহ পর্যটণে সম্ভাবনাময় অনেক স্থান রয়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সচেতন মহল আশা করেন পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও সরকারী রাজস্ব আদায়ে পর্যটণে এ উপজেলা জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখবে।