আগামী ১০ ডিসেম্বর ২৬ টি শর্তে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করার জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লিখিত অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। যে শর্তের মধ্যে রয়েছে— সেদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে সাড়ে চার ঘণ্টায় সমাবেশ শেষ করতে হবে। আগত লোকজনকে থাকতে হবে উদ্যানের বেষ্টনির মধ্যে। মিছিল নিয়ে আসা যাবে না সমাবেশস্থলে। উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
বিএনপির পক্ষ থেকে গত ১৩ নভেম্বর নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হলেও তা নাকচ করে দিয়েছে সরকার। পুলিশের অনুমতিপত্রে বলা হয়েছে- বিএনপির কার্যালয়ের বিপরীতে গণ-সমাবেশ করলে যানজট ও নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। এ কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শর্তসাপেক্ষে আগামী ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলো।
ডিএমপির পক্ষে পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া গতকাল মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) বেলা ৩টার দিকে এই অনুমতিপত্র বিএনপি কার্যালয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল করির রিজভীর কাছে পৌঁছে দেন। এই প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য আবেদন করেননি। বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে করতে চায়।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিভাগীয় শেষ সমাবেশ হবে ঢাকায়। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলেছি, নয়াপল্টনেই ১০ তারিখে সমাবেশ করব। সরকারকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, ডিএমপি কমিশনারসহ সবাইকে, কোনো ঝামেলা না করে এ সমাবেশ যাতে করতে পারি, এ ব্যবস্থা আপনারা করবেন।
অপরদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া বড় সমাবেশ সম্ভব নয়। সরকার সেখানে ভালো মনে করেই দিয়েছে। সরকার কারও কথা শুনতে বাধ্য নয়। তাছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেন্যু বিএনপিই চেয়েছে। ডিএমপি কমিশনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই উপযুক্ত মনে করেছেন।
গতকাল নেত্রকোনা জেলা ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিএনপির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালালে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা হামলা করা হবে।
তথ্য ও সমপ্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল মন্ত্রণালয়ে সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, বিএনপির সমাবেশ করার সুবিধার কথা ভেবেই সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দিয়েছে। তারা যেই সমাবেশ করার কথা বলেছে, ১০ লাখ মানুষ জড়ো হবে। সেক্ষেত্রে পুর্বাচলের বাণিজ্য মেলার মাঠ ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই। তারা যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়,তাহলে সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন,তারা যাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ নির্বিঘ্নে করতে পারেন, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সম্মেলন ৮ ডিসেম্বরের বদলে ৬ ডিসেম্বর করেছে। এরপর সেই মঞ্চ-প্যান্ডেল গুটিয়ে ফেলা হলে বিএনপি যাতে সময় নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঞ্চ বানাতে পারে। সৎ উদ্দেশ্যেই সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু বিএনপি হীন ও অসৎ উদ্দেশ্যে নয়াপল্টনে সভা করতে চায়।
গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, নয়াপল্টনেই বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ হবে। দেশের ১০ বিভাগের ভেতর ৮টিতে বিএনপির গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ হবে; এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগে হবে। সরকারের শত বাধা বিপত্তি, হত্যা, হামলা মামলা, গ্রেফতার নির্যাতন উপেক্ষা করে আমরা প্রতিটি সমাবেশ করেছি শান্তিপূর্ণভাবে। ঢাকায় গণসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু এই সরকার সারাদেশে জনগনের অভূতপূর্ব জোয়ার দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। একারনে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে আতংকগ্রস্ত। আমরা লিখিতভাবে নয়া পল্টন চেয়েছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়। নয়া পল্টনেই আমরা সবসময় সমাবেশ করে আসছি। এখানেই করবো।
রিজভী বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চায়নি। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার। এটাই আমাদের দলের সিদ্ধান্ত।
সমাবেশের ২৬ শর্ত
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬টি শর্তে বিএনপির সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ডিএমপি। উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হলো— স্থান ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে সমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে। সমাবেশস্থলের ভেতর ও বাইরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি প্রবেশ গেটে আর্চওয়ে স্থাপন করতে হবে এবং সমাবেশস্থলে আগতদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সমাবেশস্থলে আগত সব যানবাহন তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে মাইক/সাউন্ডবক্স ব্যবহার করা যাবে না। উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না। উদ্যানের বাইরে রাস্তার বা ফুটপাতে কোথাও লোক সমবেত হওয়া যাবে না। আজান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময় মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। সমাবেশ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে লোকজন সমবেত হওয়ার জন্য আসতে পারবে। সমাবেশস্থলের আশপাশসহ রাস্তায় যান ও জন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে লাঠি, রড ব্যবহার করা যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কার্যকলাপ করা যাবে না। রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদান করা যাবে না। মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না। সমাবেশস্থলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।
বিএনপি কেন নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, আমাদের তো কোনোদিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেয় না। আমরা সব সময় পার্টি অফিসের সামনেই সমাবেশ করি, এটা না দেওয়ার কিছু নেই। আমরা নিজেদের সুবিধার জন্য দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চাই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল যে পল্টনে মিটিং করেন কোনো সমস্যা নেই। এখন যদি কোনো কারণে বাধা আসে তাহলে সেটার কারণ বোধগম্য নয়।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ বলেন, এখানে জেদাজেদির কিছু নেই, লাভ-ক্ষতির কিছু নেই। ১০ ডিসেম্বর শনিবার ছুটির দিন। সব অফিস বন্ধ। নেতাকর্মীরা রিল্যাক্স মুডে সমাবেশে অংশ নিতে পারবেন। আমরা এখানে কর্মসূচি পালন করতে অভ্যস্ত। এখানে যেসব পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন তারাও অভিজ্ঞ। কীভাবে কাকে ডিল করতে হবে তারা জানেন। সব মিলিয়ে নয়াপল্টন আমরা চেয়েছি।