হারিয়ে গেছে চিঠি আদান-প্রদান

কালের আবর্তনে হারিয়ে গেছে কত কিছুই। অনেক দশক আগেও দূরে থাকা আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যমই ছিল চিঠি। শুধু দূরে নয়, খুব কাছের মানুষকেও মুখে বলতে না পারা কথাগুলোও সযত্নে সাজিয়ে জানাতেন চিঠিতে। এক একটি চিঠিতে নানান গল্প ও ইতিহাস বহন করত।

তবে বর্তমানে ই-মেইলে আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খুদে বার্তার ভিড়ে কাগজের চিঠি হারিয়ে গেছে। ছোট ছোট বাক্যে, কাটছাঁটকৃত শব্দে বিন্যস্ত এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘টেক্সটস্পিক’। কারও সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন হলেই, চট করে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ইনবক্সে পাঠানো যায়।

পহেলা সেপ্টেম্বর বিশ্ব চিঠি দিবস। চিঠি আমাদের অনুভূতি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস হলো যোগাযোগের প্রাচীন রূপকে শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়ে। বিশ্ব চিঠি লেখা দিবসটি আপনার হাতে লেখা শব্দের বিস্ময় মনে রাখার সুযোগ করে দেবে।

চিঠি বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি, নানা আবেগ। এক সময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি। মোবাইল ফোন ও ই-মেইলের যুগ আসার আগে চিঠির কদর ছিল সর্বত্র। চিঠি লেখার আবেগ বর্তমানের ম্যাসেঞ্জারের টেক্সট অথবা মেইলে পাওয়া যায় না। আগে একেকটি চিঠি যেন হয়ে উঠতো একেকজনের জীবনে প্রাণের সঞ্চার। আজকাল দাপ্তরিক কাজ ছাড়া চিঠির ব্যবহার নেই বললেই চলে। খুব কম মানুষই এখন তার প্রিয় মানুষকে নিয়ে চিঠি লেখেন।

চিঠি শুধু প্রেম নয়, সব ধরনের যোগাযোগেরই মাধ্যম ছিল। কোনো এক বেকারের চাকরির খবর, বিদেশে থাকা ছেলের মায়ের কাছে চিঠি , দেশ থেকে বিদেশে ছেলের জন্য মায়ের লেখা চিঠি। কোনো এক মৃত্যুর চিঠি আবার পরিবারে বয়ে আনত অস্থিরতা। শুধু দূরে কিংবা অদেখা মানুষকেই মানুষ চিঠি লিখত না। যার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় ও প্রতিদিন দেখা করা প্রেমিক প্রেমিকাও একে অপরকে চিঠি লিখত। কারণ, চিঠিতে যত সুন্দর ভাষায় মনের অনুভূতি গুছিয়ে প্রকাশ করা যায়, মুখে ততটা বলা হয়ে ওঠে না। শুভেচ্ছা বার্তা, খোঁজখবর নেওয়া, টাকা পাঠানো, চাকরির যোগদানপত্র সবই এক সময় আসত চিঠির মাধ্যমে। আগের মতো আর বাড়িগুলোর গেটে দেখা মেলে না চিঠির বাক্সের। প্রেয়সীর কাছে সুগন্ধি মেখে চিঠি লিখত প্রেমিক, এমন কথা অনেকেই হয়ত শুনেছেন। এসব বানোয়াট কোনো গল্প নয়, একেবারেই সত্যি।

চিঠির মূল্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নতুন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা আনন্দ লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরও একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি।’

সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চিঠি মানুষের নানামুখী অভিব্যক্তি যেভাবে আদান-প্রদান করতে পেরেছে, অন্য কোনো মাধ্যম তা পারেনি। একটি চিঠির জন্য কী ব্যাকুলতা, কী তৃষ্ণা! প্রিয়জনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে যতক্ষণ না উত্তর মিলছে, ততক্ষণ যেন মনের মেঘ কাটছেই না! রাজা লিখছেন রাজাকে, কবি লিখছেন কবিকে, প্রেমিক লিখছেন প্রেমিকাকে, সন্তান লিখছেন পিতামাতাকে—চিঠি ছাড়া যেন আর কোথাও ভাষার কোনো মুখরতা নেই! নেই প্রাণের স্পন্দন! রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের লেখা চিঠি। চিঠির ভাষা ভাবগম্ভীর হয়েও কতটা সাবলীল ও মিষ্টি হতে পারে, তাদের চিঠি না পড়লে তা বোঝার উপায় নেই।

রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতে কল্পনার আধিপত্য, মননের গাঢ়তার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে তার সৃষ্টি প্রাচুর্যের বিচিত্র ক্ষণ। তিনি চিঠি লিখেছেন বিস্তর। ইউরোপ প্রবাসীর পত্র, ছিন্নপত্র, জাভা-যাত্রীর পত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলি, রাশিয়ার চিঠি, পথে ও পথের প্রান্তে প্রভৃতি গ্রন্থে তার চিঠিপত্র সংকলিত হয়েছে, বিশ্বভারতী বের করেছে ১৯ খণ্ড চিঠিপত্র। এর বাইরে আরও কত চিঠি যে পড়ে আছে, তার হদিস মেলেনি। কবির পত্র সংকলনগুলোর মধ্যে ছিন্নপত্র সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যের নিদর্শন। ছিন্নপত্রাবলিতে উন্মোচিত হয়েছে দুর্লভ এক রবীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রনাথের গতিবিধি রহস্যময়। কবির অনেক গান, গল্প আর কবিতার সুর যেন ছিন্নপত্র-এর চিঠিগুলোতে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের এক নিভৃত কোণে বসে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জীবনের বহুমুখী চালচিত্র ছিন্নপত্র-এর পটে পূর্ণ করে এঁকেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।

বহু আগে ইংরেজ কথাকার সমারসেট মম যা বলেছিলেন, বর্তমানের বাস্তবতায় সেটাই সত্যি। চিঠি লেখা আসলেই এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। ‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’, এই গানের বোল বাধতে গিয়ে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কি কোনো দিন ভেবেছিলেন যে মানুষ একসময় শুধুই আকাশের ঠিকানায় অর্থাৎ অন্তর্জালে (ই-মেইলে) চিঠি লিখবে।

প্রযুক্তিস্রোত এসে মানুষের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে। বইয়ের পাতা উল্টানো আঙুলগুলো এখন স্মার্টফোনের রূপালি পর্দায় অবিরাম স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত। এ সময়ের বাস্তবতায় পড়াশোনা হয়ে গেছে দেখাশোনা, লেখালেখি হয়ে গেছে দেখাদেখি, ভাবনা হয়ে উঠেছে দুর্ভাবনা! মোটকথা, মানুষের মন ও মগজ—দুটিই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে নতুন নতুন ডিভাইস। ফলে চিঠি, পত্র, পত্রসাহিত্য যা-ই বলা হোক না কেন, সবই বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘লাঠি তোমার দিন গিয়াছে।’ হ্যাঁ, লাঠির দিন তো বহুকাল আগেই গিয়েছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছুরই দিন হয়তো চলে গিয়েছে। চিঠি এখন হয়ে উঠেছে ‘টেক্সট’। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের কথা ধার করেই বলা যায়, চিঠি তোমারও দিন গিয়েছে।

তবে, ১লা সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক চিঠি দিবসে চিঠি লিখতে পারেন। লাল, নীল পাতায় বাহারি রঙে মনের না বলা কথা জানিয়ে রঙিন খামে চিঠি লিখতে পারেন। যার শুরুতে প্রিয় ও শেষে থাকবে ইতি তোমারই। শুধু প্রেয়সী কিংবা প্রিয়তম একে অপরকে নয়; বাবাকে যে আপনি ভালোবাসেন, সে কথা হয়তো মুখে কখনো বলতেই পারেননি, চিঠিতে বাবাকে জানাতে পারেন সে কথা। মাকেও চিঠি লিখতে পারেন এই দিনে। পুরোনো কোনো এক বন্ধু, যে আপনার ছেলেবেলা জুড়ে আছে, এখন হয়তো যার সাথে বেশি যোগাযোগ নেই, তাকেও চিঠি লিখতে পারেন। সংসার জীবনের অনেক দিন পার করে যাদের ভেতরে এখন আর রোমান্টিকতা নেই, তারাও এই দিনে একে অপরকে মমতায় ভরা চিঠি লিখতে পারেন।