সম্প্রতি স্বর্ণ ছিনতাইয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। এতে ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়েছেন আতঙ্কিত। খোদ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্বস্তি। পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন সদস্যদের এ ধরনের অপতৎপরতা নিয়ে।
যদিও সম্প্রতি স্বর্ণ ছিনতাইয়ের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার একাধিক ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষ যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আস্থার জায়গা হিসেবে মনে করে, সেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড জনমনে আরও ভীতির সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের দায় বাহিনী এড়াতে পারে না।
রাজধানীর তাঁতী বাজারে স্বর্ণকারদের অসংখ্য দোকান। বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বর্ণ আনা-নেওয়া করা হয় সেখানে। ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ আনা-নেওয়ার কাজটি মোটামুটি গোপনেই করেন। এরপরও অনেক সময় বিভিন্ন মাধ্যমে এসব তথ্য বিভিন্ন ছিনতাকারী চক্রের কাছে চলে যায়। ছিনতাইকারী চক্রগুলোর সঙ্গে পুলিশের অসাধু কিছু সদস্যের সখ্য রয়েছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই ছিনতাইয়ের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অপরাধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চাকরিরত বিভিন্ন পুলিশ সদস্য যেমন এ কাজে জড়িত, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যরাও দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণ ছিনতাই কিংবা ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়গুলো গণমাধ্যমে উঠে আসে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক ব্যবসায়ীর ৯৬ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর লালবাগ থানার কনস্টেবল মুন্সি কামরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। ২০২২ সালের ৯ আগস্ট সেই ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা থেকে তাঁতী বাজার যাচ্ছিলেন স্বর্ণ নিয়ে। এ সময় কনস্টেবল মুন্সি কামরুজ্জামান এর নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে ছিনিয়ে নেয় ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে থাকা স্বর্ণ।
এ বছরের ১৭ জুলাই রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে থানায় নেওয়ার কথা বলে স্বর্ণ দোকানের কর্মচারী টিটুকে নিয়ে যাওয়া হয় বেড়িবাঁধ এলাকা। টিটুকে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে এএসআই জাহিদুল তার কাছে থাকা প্রায় ৩৮ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়ে যান। স্বর্ণগুলো তাঁতী বাজার থেকে টাঙ্গাইলে ভেলিভারি দেওয়ার জন্য নেওয়া হচ্ছিলে। এ সময় তার সঙ্গে ছিল পুলিশের সোর্স পলাশ শেখ।
৪০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাইয়ের অভিযোগে চলতি বছরের ১৩ জুলাই গ্রেফতার করা হয় ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার এএসআই বাবুল হোসেনকে। ৯ জুলাই ভাঙ্গা বাজার থেকে স্বর্ণ কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন নড়াইলের ব্যবসায়ী পাপ্পু বিশ্বাস। তার কাছ থেকে ৪০ ভরি স্বর্ণ অবৈধ বলে জেলে পাঠানোর কথা বলে ছিনিয়ে নেন এএসআই বাবুল হোসেন ও তার সোর্স মেহেদী হাসান।
চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০ স্বর্ণের বার ছিনতাইয়ের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় ফেনী জেলা পুলিশের পরিদর্শকসহ ছয় সদস্যকে। গ্রেফতার করা হয় সেই সময়কার ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহার হোসেন, এসআই মিজানুর রহমান, এসআই নুরুল হক, এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া ও এএসআই মাসুদ রানা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ উত্তম বনিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বর্ণ আনা-নেওয়ার নিরাপত্তার জন্য যাদের নিরাপদ মনে করি, তারাই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের শঙ্কায় ফেলেছে। আমরা তাহলে কার ওপর ভরসা করবো? স্বর্ণ আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা আশা করি আমরা। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাতে অপরাধীদের বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেই দাবিও জানাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে। স্বর্ণ ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে সুশৃঙ্খল বাহিনীর অসাধু সদস্যরা। যদিও অনেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি।’ এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কর্মকর্তাদের তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদেরও শাস্তির আওতায় আনা হলে এ ধরনের ঘটনা কমবে, আশা প্রকাশ করেন তিনি।
খন্দকার ফারজানা আরও বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালান ও পাচারের সঙ্গে সিন্ডিকেট জড়িত। এ ধরনের চক্রগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও একটি সুবিধাবাদী গ্রুপের স্বার্থ ছাড়া কাজ চালিয়ে যেতে পারে না। যারা পৃষ্ঠপোষক, কোনও না কোনোভাবে তারা ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। অথবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। সুবিধাভোগী হিসেবে তারা এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মদদ দিয়ে যায়। তবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা যেকোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলেন, পুলিশ সদস্যদের যেকোনও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলোর দায় পুরো বাহিনীর ওপর গিয়ে পড়ে। বাহিনীতে অনেক অসাধু সদস্য রয়েছে। যখনই কোনও ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিষয় সম্পর্কে পুলিশ বাহিনী অবগত হয়, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে দোষী প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া (সদ্য বদলিকৃত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘যখনই কোনও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ছিনতাই কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমরা অবগত হই, সেসব বিষয় তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত দায় বাহিনী নেবে না, নেয় না।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন