সুনামগঞ্জে পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস, কমেছে পর্যটকের আনাগোনা

২০২৪ সালে নানা ধরণের জটিলতার মধ্যে দিয়ে গেছে দেশ। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলায় তিন দফা বন্যায় জেলার মানুষের অবস্থা ছিল নাজেহাল। সুনামগঞ্জে বিগত পাঁচ থেকে সাত বছর যাবৎ পর্যটনের অপার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। জেলার তাহিরপুর উপজেলার টাংগুয়ার হাওরকে কেন্দ্রে করেই মূলত এ পর্যটন বাণিজ্য গড়ে ওঠে।

দশ বছর আগে যখন পর্যটকরা আসতেন তখন তারা ছোট নৌকায় করে ঘুরে বেড়াতেন। পর্যটকের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। কিন্ত কয়েক বছর যাবৎ সুনামগঞ্জের হাওর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘হাউস বোট’। এই বোট বা নৌকা গুলো আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন।

তবে বর্তমানে এই ব্যবসায় অনেকটাই ধ্বস নেমেছে। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আনাগোনা কমেছে পর্যটকদের। ফলে যাত্রী না পেয়ে সুরমা নদীর পাড়ে নোঙ্গর করে বসে আছে অনেক হাউস বোট। পর্যটক না আসায় সংশ্লিষ্টরা বসে অলস সময় পার করছেন। লোকসান গুণতে হচ্ছে হাউস বোটের মালিকদের। হাউস বোটের মালিকদের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যবসায় ধ্বস নামায় হতাশার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এবার সুনামগঞ্জের হাওরে সে ভ্রমণ পিপাসুদের দেখা মিলছে না। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে অবস্থিত টাগুয়ার হাওর, নীলাদ্রী লেক, লাকমাছড়ার বারিক্কাটিলা, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, নীল ঝরণাসহ নানা পর্যটন স্পট গুলোতে পর্যটকের ঢল নেই। আর এতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হাউসবোট তৈরি করা তরুণ উদ্যোক্তারা পড়েছেন চরম লোকসানের মুখে।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাউস বোটের উদ্যোক্তা অমিত রায় বলেন, ২০২২ সালে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে ‘মনসা মঙ্গল’ ও ‘চন্ডী মঙ্গল’ নামে দুটি হাউসবোট নির্মাণ করে ছিলাম। সেখান থেকে প্রথম মৌসুমে আয়ও হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ টাকা। সে কারণে ২০২৪ সালের শুরতেই নতুন আরেকটি দা আর্ক নামে হাউসবোট নিমার্ণ করি। কিন্তু বন্যার কারণে আশানুরূপ পর্যটক না আসায় লোকশান গুণতে হচ্ছে।

অমিত আরও জানান,গত মৌসুমে সুনামগঞ্জের পর্যটন স্পট ঘুরতে অনেক পর্যটক এসেছেন কিন্তু এই মৌসুমে বন্যা ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ থাকায় পর্যটকরা ঘুরতে আসছেন না। এতে আমাদের প্রতিনিয়ত লোকসান গুণতে হচ্ছে।

এদিকে, জুনের শুরুতে সুনামগঞ্জের হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসলেও হঠাৎ করে জুনে মাসের মাঝামাঝি থেকে লাগাতার ৩ দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জের সকল পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও খুলে দেওয়া হয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো।

কিন্তু দেশে সাম্প্রতিক আন্দোলনের জন্য আবারও কারফিউ জারির পর পর্যটক শূন্য হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ জেলা। এ সময় অনেক পর্যটক আটকা পড়েন। পরে যানচলাচল স্বাভাবিক হলে তারা নিজ গন্তব্যে ফিরে যান।

বর্তমানে প্রায় ৪ শতাধিক হাউসবোট এখন পর্যটকদের অপেক্ষায় সুরমা নদীর সেলুঘাট, মল্লিকপুর, লঞ্চঘাট, অচিন্তপুর ঘাটে নোঙ্গর করে আছে।

অন্যান্য বছর এ সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের দেখা মিলতো এসব পর্যটন কেন্দ্রে গুলোতে। আর এতে চাঙা থাকত হাওরের প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থনীতির চাকা। তবে এই বছর পর্যটক না আসায় একদিকে যেমন ধ্বস নেমেছে পর্যটন খাতে অন্যদিকে ভাটা পড়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থনীতিতে।

আরেক উদ্যোক্তা তানভীর আহমেদ জানান, সুনামগঞ্জে পর্যটন কেন্দ্র গুলো এই সময়ে চাঙা থাকার কথা কিন্তু চলমান এই পরিস্থিতির কারণে পর্যটকরা তাদের হাউসবোটের বুকিং বাতিল করেছেন। এতে আমরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি। সুনামগঞ্জের পর্যটন হল হাওরকেন্দ্রিক। পানি কমে গেলে আর ব্যবসা করা সম্ভব হয় না। মে মাসের শেষের দিকে হওরে পানি আর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে পানি নামতে শুরু করে। আর মূলত এই সময়টা হল হাওরে ব্যবসা করার সময়। কিন্ত এ সকল হাউস বোট ব্যবসায়ীর লোকসান হবে।

সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কর্মাস ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল জানান, এই মৌসুমে পর্যটনে যে পরিমাণের ধ্বস নেমেছে এবং যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ব্যবসায়ীরা সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। তিনদফা বন্যা ও দেশব্যাপী চলমান অস্থিতিশীলতার কারণে এই জেলায় প্রায় আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে পর্যটন খাতে।