ঘটনাস্থল সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার নাজিরবাজার। তখনও দিনের আলো ঠিকমতো ফুটেনি। ভোরের আধো আলোতেই মালবাহী ট্রাকের সাথে শ্রমিক বহনকারী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ। বিকট শব্দ শুনে পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা গিয়ে দেখেন সড়কে লাশের মিছিল, শুনেন আর্তনাদ। যেখানে প্রাণ হারান ১৪ জন নির্মাণ শ্রমিক।
বুধবার (০৭ জুন) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে স্থানীয় নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুরে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ১১জন মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে ও সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও তিনজন।
ঘটনার পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মানুষে বুকফাটা কান্না-আর্তনাদ। যে আর্তনাদ স্বজন হারানোর। এদের কেউ হারিয়েছেন একমাত্র ছেলে, কেউ হারিয়েছেন স্বামী কিংবা স্বজনদের। একটা পরিবার নিঃশেষ হওয়ার কষ্ট-আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। এ যেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। স্বজনহারাদের এমন কান্না দেখে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি।
নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। স্বজনরা জানান, নিহত সবাই নির্মাণ শ্রমিক। দৈনিক মজুরীতে তারা বাসার ছাঁদ ঢালাইয়ের কাজ করতো। বুধবার ভোরেও তারা একটি বাসার ঢালাইকাজের জন্য সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হন তারা।
ফায়ার সার্ভিস সিলেটের উপ পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান জানান, মালবাহী একটি ট্রাক সিলেটের দিকে আসার পথে বিপরিত দিক থেকে আসা একটি শ্রমিক বহনকারী একই পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, খবর পেয়ে সিলেট ফায়ারসার্ভিস ও দক্ষিণসুরমা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুরুতর আহত ১৯ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে সেখানে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত বাকি ১৬ জন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শামসুদ্দোহা।
দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ আলী (২৫), শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে দুলাম মিয়া (২৬), একই উপজেলার বাবনগাঁ গ্রামের মৃত ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৪০), দিরাই উপজেলার আলীনগর গ্রামের মৃত শিশু মিয়ার ছেলে হারিস মিয়া (৬৫), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার হলদিউড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নূর (৫০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার তলেরতন গ্রামের মৃত আওলাদ উল্লার ছেলে আওলাদ হোসেন (৬০), দিরাই উপজেলার পাথারিয়া গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫), গচিয়া গ্রামের বারিক উল্লার ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), ভাটিপাড়া গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৭), নেত্রকোনার ভারহাট্টা উপজেলার দশদার গ্রামের ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ মিয়া (৩০), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের শমসের নুরের মেয়ে মেহের (২৪), দিরাই উপজেলার মধুপুর গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে দুদু মিয়া (৪০) ও একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে বাদশা (২২)।
প্রশাসনের অর্থ সহায়তা : দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এসময় তারা দুর্ঘটনার কারণ পর্যবেক্ষণ করেন। পরে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান দুর্ঘটনায় নিহত প্রতি পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেন। বিকেলে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থ সহায়তা : দুর্ঘটনার পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এসময় তিনি হাসপাতালে হতাহতদের খোঁজ খবর নেন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করেন।
হতাহতদের পাশে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী : দুপুরে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে হাসপাতালে দেখতে আসেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। তিনি হতাহতদের পরিবারের সাথে কথা বলেন। তাদের খোঁজখবর নেন। এসময় মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার জন্য তিনি পুলিশ প্রশাসন ও বিআরটিএ-কে দায়ি করেন।
বলেন, বিআরটিএ যদি যাতেতাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স না দিতো তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতো না। কোনো প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষা না দিয়েই চালকরা লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
তিনি বিআরটিএ-এর পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকেও ঘটনার জন্য দোষারোপ করে বলেন, পিকআপে যাত্রী বহন করা সড়ক আইনে অপরাধ। এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। একটা পিকআপে এতো মানুষ উঠলো অথচ পুলিশ কিছুই করলো না। পুলিশ কোনভাবেই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
এর আগে দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। এতে দুর্ঘটনাস্থলের দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল ৮টার দিকে পুলিশি তৎপরতায় যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।