লোক সংস্কৃতির অনেক কিছুই আজ যাই যাই করছে। তেমনি একটি বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির নাম বাঘের শিন্নীর গান। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা এবং ভারতের আসাম অঞ্চলে একসময় বাঘের শিন্নীর গান বেশ প্রচলিত ছিলো।
সুনামগঞ্জের শাহ আরেফিন শাহের মাজারকে কেন্দ্র করে এ সংস্কৃতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন সময়ে গ্রামের জমিদার বা গেরস্থরা তাদের ঘরে ঘরে রাখাল রাখতো। রাখালরা গরু চড়ানোর পাশাপাশি, ধানকাটাসহ যাবতীয় গেরস্থের কাজ করে দিতো। মাঘ ফাল্গুন মাসে শীতের সময় আশেপাশের জঙ্গল থেকে বাঘ প্রজাতির প্রাণীরা গ্রামে হানা দিতো।
বাঘের শিন্নীর ছড়ায় আমরা শুনতে পাই, “আপদ বিপদ যতো আয়, রাখাইল্যারে আগে পায়। বিপদকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই।” ঠিক যেন তাই, সেই বাঘের হাত থেকে রক্ষা করতে রাখালরা রাত জেগে গ্রাম পাহারায় নেমে পড়তো। বড় শিন্নী আয়োজনের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু করতেন তারা। শিন্নীর সাথে চলতো বাঘের শিন্নীর গান।
বিলুপ্ত এই গ্রাম্য সংস্কৃতিকে মঞ্চে তুলে আনছেন সিলেটের নাট্যব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মন। এখানে আছে একদম কাঁচামাটির গন্ধ। পল্লীগানের পাশাপাশি রয়েছে গ্রাম্য ছড়া। আর আছে ভয়ংকর একটি গল্প। সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে শিশু-কিশোর, যুব নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব শীর্ষক কর্মর্সচির অংশ হিসেবে নাটকটি ২০ মে (শনিবার) বিকাল ৫টায় প্রদর্শীত হয়।
মূলত তৎকালীন সময়ে বাঘের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে সারারাত আগুন জ্বালিয়ে পাহারা দেয়া হতো। কখনোবা বিকট শব্দের নানাপ্রকার বাদ্য বাজিয়ে বাঘকে ভয় দেখাতো। যুগ যুগ ধরে বাঘ তাড়ানোর এই বিষয়টি গ্রামীণ সমাজে মিশে যায়। নাচ-গান বাদ্য-বাজনায় বাঘ তাড়ানোর রীতিনীতি হয়ে উঠে এক নতুন সংস্কৃতি। মেঘালয়ের পাদদেশে লৌকিক পীর আরফিন শাহের মাজারে বাঘ তাড়ানোকে কেন্দ্র করে “বাঘের শিন্নী” নামে শিরনী দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। বাঘের শিন্নীর মূল চালিকাশক্তি ছিলো গ্রামের গৃহস্থদের আস্থাভাজন রাখালরা। তবে আজকের দিনে রক্তলোলুপ প্রাণি বাঘ মানুষের মনোরঞ্জনের বস্তু হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে চিড়িয়াখানায়। বাঘের অত্যাচার থেকে মানুষ আজ মুক্ত। নাট্যকার ভবতোষ রায় বর্মণ বাঘকে সমাজ জীবনের পশুত্বের সাথে তুলনা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লেবাসধারী পশু এবং ৭১ পরবর্তী মানুষরূপী প্রেতাত্মাদেরও নাটকের গল্পে সরাসরি তুলে ধরা হয়েছে।
সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমির অভিনয় বিভাগের আয়োজনে “বাঘের শিন্নী” নাটকে অভিনয় করেছেন- ফয়সাল খলিলুর রহমান, অপু সেনাপতি, এফএম শিমুল হাসান, আলীরেজা হাসিব, প্রান্ত ধর, সংগীতা সিনহা, দেবী রাজলক্ষ্মী তালুকদার, শুভ্রদীপ দাশ শুভ, ধৃত তালুকদার, অসীম সরকার, দ্বীপন তালুকদার আকাশ, মিহরাব আহমদ চৌধুরী হোসাইন, পবিত্র মন্ডল, সুমন চক্রবর্তী, বিপ্রজীত ভট্টাচার্য্য, মির্জা ফজলে জান্নাত মাশরাফি, শিনিয়া সাহা ঝুমা, মনিষা রায় অমি, জাওয়াতা আফনান রোজা, মো. জাকারিয়া আহমেদ রাহাত, সুষ্মিতা অ্যানিসহ নাটক বিভাগের প্রশিক্ষণার্থীবৃন্দ।
নাটকটি প্রসঙ্গে নাট্যকার ভবতোষ রায় বর্মণ বলেন, “যুগ যুগ ধরে গ্রামের রাখালরা দেশ ও সমাজকে রক্ষা করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধেও গ্রামের রাখালরাই শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা গড়ে তোলেন। চাষাভূষা বা দুই কড়ার রাখাল বলে তাদের আমরা সমাজের নিম্নস্তরে রেখে দিই। অথচ তাদের হাতেই বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির রক্ষাকবচ। বাঘের শিন্নী নাটকে আমি বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ভাটির বিলুপ্ত সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে এ বিষয়টিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”