বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩’ এ ভূষিত হয়েছেন সুনামগঞ্জের কৃতিসন্তান, লোক গবেষক ও সাংবাদিক সুমনকুমার দাশ। অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন। লোকসাহিত্য (ফোকলোর) বিভাগে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সুমনকুমার দাশ কথা বলেছেন তাঁর বেড়ে ওঠা, সাহিত্যকর্ম ও বিস্তর ভাবনা নিয়ে।
তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদ রহমান।
তাওহীদ : লোকসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতিটা কেমন ছিল?
সুমনকুমার দাশ : প্রথমত, স্বাভাবিক একটা ভালো লাগা তো কাজ করে। রাষ্ট্র একটা সম্মান জানিয়েছে। তো আমি সবসময় একটা কথা বলে থাকি যে, পুরস্কারটি কেবল আমার যে প্রাপ্তি তা নয়-আমি যাদেরকে নিয়ে কাজ করি তারা হচ্ছেন এই বাংলার সাধক, শিল্পী, মহাজন। তারা গ্রামীণ বাংলায় লোকায়ত ধারার সাহিত্যকে বিকশিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের জীবন, দর্শন এবং সাহিত্য নিয়ে মূলত আমার কাজ করা। তাদের সৃষ্টিকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করতেই আমি কাজ করি। এক অর্থে এই পুরস্কারটি আমি পেলেও বলা যেতে পারে আমি একজন সূত্রধরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। পুরস্কারটি মূলত তাদেরই প্রাপ্য। তাদের বদান্যতার কারণেই মূলত আমি পুরস্কারটি পেয়েছি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদেরকে এবং আমি মনে করি যে, এই পুরস্কারটির মূল ভাগীদার হচ্ছেন সেসব গ্রামীণ মহাজন, শিল্পী- সাধকেরা।
তাওহীদ : প্রাকৃতজনদের আচার, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার আগ্রহ কেন জাগল?
সুমনকুমার দাশ : আসলে আমার জন্ম হাওর অঞ্চলে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। তো ছোটবেলা থেকেই রাতভর আমরা যাত্রা গান দেখতাম। দেখা যাচ্ছে পড়া ফাঁকি দিয়ে আমরা যাত্রা গানের আসরে চলে গেছি, মালজুরা গানের আসরে চলে গেছি কিংবা কোথাও কীর্তন গানের আসরে চলে গিয়েছি। আমার বেড়ে ওঠাটা মূলত হাওরের নানান লোকজ সাহিত্যের, লোকজ মাধ্যমের লোকনাট্য কিংবা লোকগানের আসর দেখতে দেখতে। বড় হয়ে যখন আমি শহরবাসী হলাম, তখন দেখলাম যে শহরের অনেক মানুষ এইসব আচার বা সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আমার মনে হল যে, এইসব বিষয়গুলো শহরের মানুষকে জানানো প্রয়োজন। সে কারণেই আমার লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করার মূল ইচ্ছেটা জাগে।
তাওহীদ : লোকনাট্য ও লোকগানের যে বিশাল সংগ্রহ আপনি করেছেন, এই যাত্রাটা কেমন ছিল?
সুমনকুমার দাশ : আসলে অচেনা কে চেনাতেই আমার আনন্দ লাগে। আমার মনে হয় যে যেসব ধারাকে মানুষজন জানেন না, সেসব উপধারাগুলো সম্পর্কে মানুষকে পরিচিত করা প্রয়োজন। এবং আমি কিন্তু কাজ করার ক্ষেত্রে প্রথমেই ভেবেছি যেসব কাজ অতীতে কখনো হয়নি উদাহরণস্বরূপ- বেদে সংগীত। বেদে বাইদানিদের খুব প্রচলিত সংগীত ছিল, সেগুলো নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। আমার মনে হল সেসব সঙ্গীতকে মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আমি ভাবলাম, ‘বেদে সংগীত’ নামে একটি বই করা যেতে পারে। করা যেতে পারে ভিক্ষু সংগীত। ভিক্ষুরা কিন্তু অনেক গান পরিবেশন করে। এই ধরনের বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে আমার কাজ Show আগ্রহ জাগে। এভাবে বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে করতে করতে কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এবং আগ্রহ থেকেই এসব গানগুলো সংগ্রহ করি। সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নেশা থেকেই কাজ করা।
তাওহীদ : ফোকলোরে কাজের ক্ষেত্রটা কেমন চ্যালেঞ্জের?
সুমনকুমার দাশ : এটি ব্যক্তিগতভাবে করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জিং। সরকারি কোনো উদ্যোগে বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হলে ভিন্ন কথা। এটাতো ফিল্ডওয়ার্ক ও সমীক্ষা ভিত্তিক কাজ ফলে এখানে টাকা পয়সার প্রয়োজন রয়েছে। কোথাও যদি যেতে চান তবে যাতায়াতের একটা খরচ রয়েছে। তাছাড়া আপনি রেকর্ড করবেন, সেটা ভিজ্যুয়ালি হোক বা লিখে আনেন- সেগুলো অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে করা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। সরকারী কিংবা বেসরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতায় যদি ফোকলোরের নানা উপাদানগুলো সংগ্রহ করা যায় তবে ভালো হয়।
তাওহীদ : লোকসাহিত্যের পথিকৃতদের মধ্যে তাঁদের জীবদ্দশায় অনেকের সাথেই তো আপনার দেখা হয়েছে।
সুমনকুমার দাশ : হ্যাঁ, এ ধরনের অনেক মানুষের সাথেই আমার মধুর স্মৃতি রয়েছে। যেমন বাউল শাহ্ আব্দুল করিম ও তাঁর জীবনাচার আমি কাছ থেকে দেখেছি। আমি রামকানাই দাশের কথা বলতে পারি কিংবা বিজিত লাল দাশ, কফিল উদ্দিন সরকার, চন্দ্রাবতী রায় বর্মন। এরকম অসংখ্য সাধক-মহাজনদের সাথেই আমার ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়েছে।
তাওহীদ : সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলেই আপনার বেড়ে ওঠা। শিল্প সাহিত্যের জন্য সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জের সন্তান হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন নিশ্চয়ই?
সুমনকুমার দাশ : আলাদা করে সুনামগঞ্জ নয়, আমাদের এই বৃহত্তর সিলেটকেই বলা হয় সুরের পণ্যভূমি। সিলেটের বিভিন্ন জেলার আনাচে-কানাচে অসংখ্য সাধক রয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামেই অনেকের জন্ম। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ একটু ব্যতিক্রম। সেখানে অনেক বিশিষ্ট সাধক-মহাজনের জন্ম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই একটি হাওর অঞ্চলে নানা ধরনের পরিবেশ, সেখানকার বারো মাসে তেরো পার্বণ আমরা বলে থাকি। প্রকৃত অর্থেই এই সুনামগঞ্জের ক্ষেত্রে সেটি একেবারেই সত্য বিষয়। এ ধরনের লোকসাহিত্য নির্ভর একটি সমৃদ্ধ জনপদে আমার জন্ম হয়েছে, আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। নিঃসন্দেহে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি সুনামগঞ্জের সন্তান হিসেবে।
তাওহীদ : সিলেট অঞ্চলের লোক সাহিত্য সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
সুমনকুমার দাশ : আমি তো বলে থাকি যে, এই বঙ্গভূমিতে অর্থাৎ এই বাংলাদেশের আমরা যতসব লোকসাহিত্যের নানা ক্ষেত্র ধারার কথা বলি, সিলেট একটু বিরল ব্যতিক্রম। সিলেটে অসংখ্য লোকগানের সৃষ্টি হয়েছে, লোকনাট্য ধারার জন্ম হয়েছে- অনেক ধারা-উপধারার জন্ম ও উদ্ভব হয়েছে, বিকাশ এবং বিস্তার ঘটেছে এই সিলেটে। সেজন্যই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম এবং খুবই সমৃদ্ধ একটি লোক ঐতিহ্যবাহী জনপদ। তো, এই অঞ্চলে ঐ অর্থে কাজের যতটা প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। অবশ্য অনেকেই কাজ করেছেন। এবং আশার কথা হচ্ছে অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন নতুন করে কাজ করার। সিলেটের লোকসাহিত্য গুলো প্রচারের ক্ষেত্রে অনেকেই ভূমিকা রাখছেন।
তাওহীদ : সবশেষে, বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি কোন ব্যক্তিবিশেষকে উৎসর্গ করেছেন কি না?
সুমনকুমার দাশ : শুরুতেই বলেছি, আমি মূলত সূত্রধরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। ব্যক্তি বিশেষ নয় বরং, উৎসর্গ করতে হবে সেইসব সাধক, মহাজনদের যাদের সৃষ্টিশীলতাই আমাকে তাদের সৃষ্টির ক্ষেত্র, কৌশল এবং সৃজনীশক্তির নির্যাস খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাওহীদ : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও আন্তরিক অভিনন্দন।
সুমনকুমার দাশ : আপনাকে এবং সিলেট ভয়েস পরিবারকে ধন্যবাদ।