সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজের নির্ধারিত সময় গতকাল মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) শেষ হয়েছে। তবে এখনও শেষ হয়নি নির্ধারিত প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পে এখনও মাটিই পড়েনি।
জগন্নাথপুর উপজেলার সর্ববৃহৎ নলুয়া হাওরের কয়েকটি বাঁধের কাজ পরির্দশনকালে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় এখনও মাটি পড়েনি। তবে কাজ চলমান রয়েছে। হাওরের পোল্ডার-১-এর আওতাধীন ৯ নম্বর প্রকল্পের ১ কিলোমিটার ২৪৬ মিটার দৈর্ঘ্য বাঁধের ৭০০ ফুট এলাকায় এখনও মাটি পড়েনি। ১০ নম্বর প্রকল্পের ভাঙা গর্তে কাজ এখনও চলমান। ১১ নম্বর ও ১৩ নম্বর প্রকল্পের ৩০০ ফুট এলাকায় মাটির কাজ বাকি রয়েছে। এছাড়া ৩ থেকে ৮ নম্বর প্রকল্পে মাটি ফেলা হলেও শেষ হয়নি বাঁধের নির্ধারিত কাজ।
নলুয়া হাওরাঞ্চলের ভুরাখালি গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান জানান, বাঁধের কাজের সময়সীমা শেষ হলেও এখনও এক কিলোমিটার এলাকায় মাটির কাজ হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হলে ফসল নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হবে।
কাজের ব্যাপারে ১১ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি রুবেল মিয়া জানান, দুই-তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। ৯ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি আব্দুস শহিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সাড়া মেলেনি। ৪ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি রনধীর কান্ত দাস নান্টু জানান, তার প্রকল্পের কাজ শেষ। এখন সেখানে দূর্বা লাগানোর কাজ চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জগন্নাথপুর উপজেলায় এবার ৪৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। এসব কাজের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। নিয়ম অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দিলাওর হোসেন জানান, নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক। কাজের ধীরগতি ও অবহেলায় ফসল নিয়ে চিন্তিত হাওরের কৃষকরা।
কমিটির জগন্নাথপুর শাখার আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হাওরের একটি বাঁধেরও শতভাগ কাজ শেষ হয়নি। কয়েকটি প্রকল্পে মাটিই পড়েনি।
তবে পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী হাসান গাজী জানান, কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি নেই। নলুয়া হাওরে এখনও যে কয়েকটি স্থানে মাটি পড়েনি সেগুলো প্রকল্পের কাজের আওতাভুক্ত নয় বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে, তাহিরপুর উপজেলায় ৭০ ভাগ পর্যন্ত কাজ হয়েছে বলে দাবি করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের তাহিরপুর উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী উপজেলা হাওররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব শওকত উজ্জামান।
তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত ৭০টির বেশি বাঁধের মাটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ আগামী সাপ্তাহেই শেষ হবে।
তবে হাওরপাড়ের বাসিন্দা, কৃষক ও সচেতন মহল বলেছেন, সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ কাজ হয়েছে। অনেক বাঁধে এখনও মাটির কাজই শেষ হয়নি। তাই বোরো ফসলের উপর নিভর্রশীল লাখো কৃষকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রাক্কলন শেষ করে ১৫ ডিসেম্বর ফসলরক্ষায় বাঁধের কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলতি বছরে ১১ জানুয়ারি প্রথম ধাপে ৩০টি ও ২১ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ৮৩টি পিআইসি ঘোষণা করে পাউবো। এর ফলে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার সরকারি নির্দেশ থাকলেও তা আর হচ্ছে না।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম হাওর রক্ষা বাঁধ পরির্দশনে এসে বলেন, আগামী ৭ মার্চের মধ্যে সকল বাঁধের কাজ শেষ করা হবে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের উপজেলা শাখার নেতা তোজাম্মিল হক নাসরুম জানান, এবারও গুরুত্বপূর্ণ বাঁধের কাজে ঢিলেমি লক্ষ্য করা গেছে। পাউবো বরাবরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে না। সঠিক সময়ে হাওর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু না হওয়ায় দেরিতে তড়িগড়ি করে বাঁধের কাজ করতে গিয়ে প্রতিটি বাঁধেই ঝুকিঁপূর্ণ ও দুর্বল হয়। ফলে বৃষ্টির পানি ও সামান্য পাহাড়ি পানির ঢলের চাপে বাঁধ ভেঙে পানি হাওরে প্রবেশ করে। এবারও লাখ লাখ কৃষক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতংকের মধ্যে সময় পার করছে। এবার হাওরের কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার পাউবোসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাসান উদ দৌলা বলেন, চলতি মৌসুমে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ১৭ হাজার ৩৯৩ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি চাল উৎপাদন হবে। এর মূল্য ২শ ৪৪কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি।
শনির হাওরের কৃষক কাদির মিয়া জানান, সময়মত বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়া, সেই সাথে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতি বছরই ৪০ ভাগ কাজ হয় না। সরকার ফসল রক্ষা বাঁধের বিষয়টি গুরুত্ব দিলেও বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দায়িত্বশীলরা গুরুত্ব দেন না। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজের বেলায় দেরি ও নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করায় সরকারের অর্থের অপচয়ের সাথে সাথে হাওর ধ্বংস হচ্ছে। ফলে সামান্য পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাঁধগুলো ভেঙে হাওরগুলো ডুবে যায়। এবারও বোরো ফসল হারানোর আতংকে আছি, কারণ এখনও বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা জানান, আমি সরেজমিন বিভিন্ন হাওরের বাঁধের কাজ পরির্দশনে গিয়ে পিআইসিদেরকে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য তাগিদ দিচ্ছি। এবং বাঁধের কাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী সাপ্তাহে সব বাঁধের কাজ শেষ হবে। যারা সরকারি নীতিমালা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চলতি বছরে ফসল রক্ষা ডুবন্ত বেড়িবাঁধ, খাল (ক্লোজার) বন্ধে তাহিরপুর উপজেলায় এবার মোট ১১৩টি পিআইসি অনুমোদন করে ৮৪.৫০০ কিলোমিটার বাঁধে ২০ কোটি ৯৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
অন্যদিকে, ছাতকের হাওরে ধীর গতিতে চলছে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ। এখনো বাঁধ নির্মাণ কাজের অর্ধেকও শেষ হয়নি। এতে করে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) দাবি, আর্থিক সংকটের কারণে কাজের বিলম্বিত হচ্ছে। সরকারি বরাদ্দের টাকা না পেয়ে ধারদেনা করে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
অপরদিকে, কৃষকরা দ্রুত বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করার দাবি তুললেও পিআইসিগুলোর কাজ ধীর গতিতে চলছে। এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ দৃশ্যমান হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী, ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ৪৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছর উপজেলায় বিভিন্ন হাওরের ফসল রক্ষায় ৩৭টি প্রকল্প (পিআইসি) কাজ করছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে জাউয়াবাজার নোয়ারাই, চরমহল্লা, খুরমা উত্তর, খুরমা দক্ষিণ ও সিংচাপইড় ইউনিয়নের ৩৭ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি টাকা। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির অনুকূলে ২৫ শতাংশ টাকা অগ্রিম দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু উপজেলার হাওর রক্ষায় ৩৭ প্রকল্পের মধ্যে কোনো প্রকল্পেই অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়নি। কাজ শুরুর পর ২৩ প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হলেও ১৪ প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকাই পরিশোধ করা হয়নি।
৫ নম্বর প্রকল্পের (পিআইসি) সভাপতি আব্দুল হক বলেন, প্রকল্পের কার্যাদেশ পেতে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। এ প্রকল্পে মাটি ভরাট কাজ শেষ, এখন ড্রেসিংয়ের কাজ চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বাঁধে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ হবে।
২৪ নম্বর প্রকল্পের (পিআইসি) সভাপতি আব্দুর নুর বলেন, প্রকল্পের প্রায় ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। মাটি অনেক দূর থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
১২ নম্বর প্রকল্পের (পিআইসি) সভাপতি এখলাছুর রহমান বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।
৭ নম্বর প্রকল্পের (পিআইসি) সভাপতি মমশর আলী বলেন, বাঁধ মেরামতের প্রায় ৬৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্পের মাটি ভরাট কাজ শেষে ড্রেসিংয়ের কাজ চলমান। এ পর্যন্ত ১ম কিস্তির টাকা পেয়েছেন তিনি।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন বলেন, পিআইসি কমিটি কাজ শুরু করতে বিলম্ব করায় ও ফান্ড স্বল্পতায় বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। শিগগিরই টাকা পরিশোধ করা হবে।
ছাতক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প কমিটির সভাপতি নুরের জামান চৌধুরী বলেন, শুরুতে পিআইসি গঠনে কিছুটা দেরি হয়েছে। প্রকল্পের কাজ নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ শেষ করা হবে।