মাস দুয়েক আগে (১১ জুন) পড়াশোনায় অকৃতকার্য হওয়াসহ নানা হতাশা থেকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মানিক বাড়ৈ। মরদেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তার লেখা একটি চিরকুট। তাতে তিনি লিখেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি ব্যক্তি-হতাশার কারণে আত্মহত্যা করছি।’
এ ঘটনার আগের মাসে (১৯ মে) রাজধানীর গ্রিন রোডে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন এক শিক্ষার্থী। ইমাম হোসেন (২৩) নামে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন, ইমাম বেশ কিছু দিন ধরে অন্যমনস্ক ছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না তিনি, একাকী থাকতেন। কোনও মানসিক যন্ত্রণা থেকে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
গবেষণা বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে (আট মাস) দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তার মধ্যে বিদ্যালয়গামী (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার্থী ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজের শিক্ষার্থী, ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শতকরা ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
আজ শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। গত তিন বছর ধরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’। বিশ্বে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা দিবসটি পালন করে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত আট মাসে আত্মহননকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। আর চলতি বছরে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন অভিভাবকরা। কী আচরণ করলে সন্তানদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার প্রসার ঘটবে, তা নিয়েও ভাবছেন অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা থেকে সন্তানদের দূরে রাখারও চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
কলেজপড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মা সালেহা খাতুন নিজ অভিজ্ঞতা জানাতে বলেন, ‘আগে এরকম ভয় লাগতো না। এখন কোনও বিষয়ে চট করে ‘‘না’’ বলতে ভয় লাগে। বেশ কিছু দিন ধরে একের পর এক আত্মহত্যার খবর দেখতে পাচ্ছি। সন্তানরা একেক বয়সে একেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করি না। তাকে এমন কিছু পরামর্শ দিয়ে ফেলি, যাতে সে নিজের পরিবারের কাছেই নিরাপদ বোধ করে না। ফলে অভিভাবকদেরও আচরণ বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
স্কুলপড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থীর বাবা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘এ সমাজে বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হয় না। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবী। মেয়েকে দেওয়ার মতো অনেক সময় আমাদের থাকে না। চারপাশের আত্মহত্যার খবরগুলো যখন দেখছি তখন ভয় করে। মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কোনোভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। রেজাল্ট খারাপ হলে আমরা সবাই মিলে আরেকটু বেশি পড়ালেখা করবো। কিন্তু কোনও চাপ যেন সে বোধ না করে। তারপরও কিশোর বয়সে তো কোনও যুক্তি কাজ করে না।’
সহনশীলভাবে সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলেন, আমরা সামাজিক পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছি। একদিকে সমাজ ভাঙছে, আরেকদিকে প্রযুক্তি জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। সন্তানের কাছে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। তার মন খারাপ হবে, সে বিরক্ত হবে। সেসবের কারণগুলো যেন চিহ্নিত করতে পারে, সেজন্য তাকে সাহায্য করতে হবে। পরিস্থিতি এড়িয়ে না গিয়ে তার সাথে আলাপ করতে হবে। অভিভাবকরা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করবেন, যাতে সন্তানের মনে হয় যে—সে চাইলেই যেকোনও সমস্যা বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘শিশু স্বাধীনভাবে বড় হবে ঠিকই, কিন্তু একটা যথাযথ মনিটরিং থাকবে। কারণ, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ; সে পুরোটা তখনও বোঝে না। ফলে মূল কাজটি অভিভাবকের। একজন বাবা কিংবা মা হওয়ার পরে কীভাবে অভিভাবক হয়ে উঠবেন, সেই শিক্ষাটারও দরকার আছে। সেটা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।’