হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক ইউনিয়নের সাতাউক মাঠে মৌ চাষি ছুরত আলীর স্থাপনকৃত ২৯টি মৌ বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হয়েছে। শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মতো মধু সংগ্রহ করেন মৌ চাষি মো. ছুরত আলী। শীতের তীব্রতায় উৎপাদন কম হওয়া সত্ত্বেও এক সপ্তাহে ২৯টি মৌ বাক্স থেকে প্রায় ৬০ লিটার মধু সংগ্রহ করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, সরিষা নির্ভর মধু চাষ লাখাইয়ের অন্য কোনো মাঠে করা হয়নি। তা করতে পারলে উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা ছিল।
প্রতি মৌসুমের মতো এবারও লাখাইয়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে হলুদের সমারোহ দেখা যাচ্ছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু হলুদের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে সরিষার ফুল। লাখাইয়ের মুড়িয়াউক, সাতাউক, মোড়াকরি, গুনিপুর, সিংহগ্রাম, বামৈ, করাব, মৌবাড়িসহ প্রায় প্রতিটি গ্রামের মাঠে এ দৃশ্য নজরকাড়া।
লাখাই উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লাখাইয়ে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ১২০ হেক্টর। তবে চাষ হয়েছে ২ হাজার ৪০০ হেক্টরেরও বেশি জমি। বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, কোনো কোনো জমিতে ফুল ফুটেছে, আবার কোনোটিতে ফুল ফোটার উপক্রম।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন মাঠ পরিদর্শনকালে সাতাউক ও মুড়িয়াউক গ্রামের কয়েকজন সরিষা চাষির সাথে আলাপকালে জানা যায়, এ বছর সরিষার ফলন আশানুরূপ হওয়ায় তারা প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন করতে পারবেন বলে আশাবাদী।
সাতাউক গ্রামের সাজু মিয়া (৫৫) বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। সমুদয় খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকার মতো। যে ফলন হয়েছে তাতে দুই বিঘায় ৬-৭ মন সরিষা পাবো বলে আমি আশাবাদী। এতে আমার খরচ বাদে ২০-২৫ হাজার টাকার মতো মুনাফা হবে।
মুড়িয়াউক মাঠে আলাপ হয় ওই গ্রামের চাষি আব্দুল কবিরের (৬০) সাথে। তিনি বলেন, আমি এ বছর আমার চার বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকার মতো। আশা করি আমার জমিতে যে ফলন হয়েছে তাতে ২২-২৪ মন সরিষা পাবো। এতে আমার ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো মুনাফা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মাঠে বোরো ধান আবাদ হয় না। যেহেতু এ মাঠে এখনও ডিপ টিউবওয়েল বসেনি বা এর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তাই আমরা শুধু বোনা আমনের ওপর নির্ভরশীল। আর বোনা আমনের ফলন খুব কম। প্রতি বিঘায় বড়জোর ৬ মন ধান হয়। এতে খরচ বাদে মুনাফা হয় না। তাই আমরা রবিশস্য সরিষার ওপর মূলত নির্ভর করে আসছি। এ সরিষা থেকে নিজেদের তেলের চাহিদা মেটে এবং বাড়তি যে অর্থ পাই তাতে সংসারের খরচ মেটাতে সমর্থ হই।
মুড়িয়াউক গ্রামের আলকাছ মিয়া ও রুবেল মিয়ার সাথে আলাপকালে তারা বলেন, আমাদের ধান চাষে তেমন কোনো লাভ হয় না। তাই আমরা সরিষা, গম, ধনিয়ার মতো ফসল যখন যেটা সুবিধাজনক মনে হয় আবাদ করে আসছি। এ বছর সরিষা বেশ লাভজনক হওয়ায় আমরা আশাবাদী।
এদিকে সরিষার আবাদ বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে মৌ চাষি ছুরত আলী উপজেলার সাতাউক মাঠে মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন। তিনি ২০১৫ সাল থেকে লাখাইয়ের কোনো না কোনো মাঠ থেকে মধু সংগ্রহ করে আসছেন।
এ বছর সাতাউক মাঠে মৌ বাক্স নিয়ে আসা এই মৌ চাষি বলেন, লাখাই সরিষা নির্ভর মধু আহরণের সম্ভাবনাময় অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও অন্য কোনো মৌ চাষি এখানে আসেন না। কারণ এই এলাকার কৃষকেরা বোঝে বা না বোঝে সরিষার জমিতে কীটনাশক ছিটিয়ে দেন। এতে মৌমাছি মারা পড়ে। তবে দিন দিন অনেক কৃষকের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় তারা আমাকে সহযোগিতা করছেন। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও আমাকে সহযোগিতা করছে।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকিল খন্দকার বলেন, লাখাইয়ে সরিষা নির্ভর মধু সংগ্রহ করতে আমরা মৌ চাষিদের সহযোগিতা করে আসছি। লাখাই উপজেলার প্রতিটি সরিষার মাঠ থেকে যাতে মধু আহরিত হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। মৌ চাষিদের সাথে যোগাযোগ করে আসছি।
তিনি আরও বলেন, মৌমাছি সরিষার পরাগায়নে সহায়তা করে থাকে এবং সরিষায় রোগ-বালাই কম হয়ে থাকে। এতে ফলন ১৫-২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ব্যবহার কমে যাওয়ার ফলে উৎপাদন খরচও কম হয়।