যে কারণে চাল আমদানি করছেন না আমদানিকারকরা

সরকারের নানা উদ্যোগের পরও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে চাল আমদানি করেননি আমদানিকারকরা। বিষয়টি সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। যে কোনও ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সরকার এ পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে পাঁচ লাখ টনেরও বেশি পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেয়; তবে এ পর্যন্ত এসেছে মাত্র এক লাখ টন চাল। চলতি বছরের ৩০ জুন সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন নিলেও নির্ধারিত সময়ে এলসি পর্যন্ত খোলেননি আমদানিকারকরা। সরকারের পক্ষ থেকে চালের আমদানি শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানিতে উৎসাহিত করা যায়নি তাদের। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ৩০ জুনের এক আদেশে বেসরকারি পর্যায়ে নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল এবং আতপ চাল আমদানির জন্য ৯৫টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৪ লাখ ৯ হাজার টনের বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) আরও ৭৯ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে বেসরকারিভাবে আরও ৭৯ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য ২৩টি প্রতিষ্ঠান অনুমতি পাবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে আমদানির অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল ৬১ হাজার টন এবং আতপ চাল ১৮ হাজার টন।

চাল আমদানির শর্তে বলা হয়েছে, বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করতে হবে। আমদানি করা চালের পরিমাণ গুদামজাত ও বাজারজাত করার তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে জানাতে হবে। বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) ইস্যু বা জারি করা যাবে না। আমদানি করা চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান নামে ফের প্যাকেটজাত করা যাবে না। আমদানি করা বস্তায় চাল বিক্রি করতে হবে বলেও শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকদিন ধরেই অস্থিতিশীল চালের বাজার।

৩০ জুনের এক আদেশে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া বরাদ্দপত্রে সাত ধরনের শর্ত দেওয়া আছে। এগুলো হচ্ছে- ২১ জুলাইয়ের মধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে এলসি খুলতে হবে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য (বিল অব এন্ট্রিসহ) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে হবে। বরাদ্দপ্রাপ্ত আমদানিকারকদের ১১ আগস্টের মধ্যে সমুদয় চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করতে হবে। আমদানি করা চালের পরিমাণ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে অবহিত করতে হবে। বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি ইস্যু করা যাবে না। আমদানিকৃত চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনঃপ্যাকেটজাত করা যাবে না। আমদানিকৃত বস্তায় চাল বিক্রি করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে এ বরাদ্দ আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।

চাল আমদানিকে উৎসাহিত করতে গত ২৮ আগস্ট আমদানি শুল্ক মওকুফ ও রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর চাল আমদানির গতি কিছুটা বাড়ালেও বাজারে চালের দাম কমেনি। ফলে কম শুল্কে চাল এনে বাড়তি দামে বিক্রি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্রেতার পকেট কাটছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ভুল পলিসি ও লোকসানের শঙ্কা

সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের ভুল পলিসির কারণেই আমদানিকারকরা চাল আমদানি করতে উৎসাহী হচ্ছেন না। তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী ১৫ টাকা ও ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির আওতায়ও চাল বিক্রির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে তো চালের ক্রেতা কমে যাচ্ছে। চাহিদা কমছে। ব্যবসায়ীরা আমদানি করে এনে সেই চাল বিক্রি করবে কার কাছে? এমন পরিস্থিতিতে চাল আমদানি করলে সেই চাল নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শর্তে বিক্রি করতে পারবে না। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, লোকসানের মুখে পড়বেন। এ কারণেই আমদানিকারকরা চাল আমদানিতে উৎসাহী হচ্ছেন না।

তাদের দাবি, অবশ্যই সরকারের কর্মসূচির চাল বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। এটি করা গেলে আমদানি করা চালের বাজার সম্প্রসারিত হবে। বাজারে চালের চাহিদা সৃষ্টি হবে। ক্রেতা মিলবে। আমদানিকারকরা উৎসাহী হবেন চাল আমদানিতে। কারণ আমদানির শর্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে আমদানি করা চাল বাজারে ছাড়তে হবে। বাজারে যদি চালের চাহিদা না থাকে, ক্রেতা না থাকে, তাহলে আমরা চাল বাজারে ছাড়বো কীভাবে। কিনবে কে? বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবনায় আনতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাবুবাজার-বাদামতলী চাউল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিজামউদ্দিন জানিয়েছেন, চাল আমদানি করে কেউ লোকসান দেবে না। আর যেখানে লোকসানের আশঙ্কা থাকবে সেখানে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে না। আগে বাজারে চালের চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। তার পরেই চাল আমদানি বাড়বে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।

তিনি আরও জানান, ব্যবসায়ীরা যদি মনে করেন প্রতি কেজিতে এক টাকা লাভ হবে, তাহলে চাল আমদানি করে দেশ ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু লোকসানের আশঙ্কা থাকলে তো আর সেটা সম্ভব নয়।

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সরকার জিম্মি

বিশ্লেষকরা বলেছেন, চালের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যখন যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। এতে সাধারণ মানুষের কোনও কোনও লাভ হচ্ছে না। আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কঠোর জবাবদিহিতায় আনা না গেলে চালের দাম কমানো সম্ভব না। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল সিন্ডিকেটের অসাধু সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, যারা অনুমোদন নিয়েও চাল আমদানি করেনি বা এলসি খোলেনি তাদের নতুন করে আর বরাদ্দ দেওয়া হবে না। তাদের ব্যবসার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বরাদ্দ নেওয়ার পরও যারা চাল আনছে না তাদের আইআরসি সাসপেন্ড করার ব্যাপারে শিগগিরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে নিজেদের কোম্পানির নামে বস্তাজাত করে চাল আমদানির কোনও সুযোগ নেই। এটা কেউ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলার সুযোগ আছে।’

মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, শর্ত অনুযায়ী এলসি না খোলায় নির্ধারিত সময়ে (১১ আগস্টের মধ্যে) বেশিরভাগ চাল দেশে এনে বাজারজাত করেনি আমদানিকারকরা। উল্টো ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ১৭ আগস্ট খাদ্য মন্ত্রণালয় এলসি খোলার সময়সীমা আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এরপরও চাল আমদানির গতি সন্তোষজনক নয়। আমদানিকারকরা ভারত থেকে বেনাপোল, হিলি ও ভোমরা বন্দরসহ আরও কয়েকটি পথে চাল আমদানি করে।

ব্যবসায়ীদের লুকোচুরি

বিভিন্ন স্থল বন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১০-১৫ জন আমদানিকারক মাত্র ৯০ হাজার ৯৭৫ টন চাল আমদানি করেছে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে জুলাই ও আগস্টে আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ১১৮ টন। আমদানি শুল্ক মওকুফ ও রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ কমানোর পর সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনেই আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৩২০ টন। ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে জুলাই-আগস্ট দুই মাসে চাল আমদানি হয়েছে ১৯ হাজার ৫০২ টন। সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনেই আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৪০২ টন। আর বেনাপোল দিয়ে জুলাই ও আগস্টে চাল আমদানি করা হয়েছে ১৭ হাজার ৪২৭ টন। শুল্ক মওকুফের পর সেপ্টেম্বরের ১৫ দিনে আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ২০৬ টন। অভিযোগ রয়েছে— শর্ত অনুযায়ী আমদানি, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের কোনও তথ্যই জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিসকে অবহিত করেন না আমদানিকারকরা।

এদিকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাখতেই সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকবে বলেও জানান মন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রী বলেন, চাল আমদানির ফলে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বাজার স্থিতিশীল রাখতেই সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। চাল আমদানি আমাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টার্গেট আছে। সেই পরিমাণ চাল দেশে এসে গেলে আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চালের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। যা কার্যকর থাকবে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত।