যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুযায়ী প্রথম দিন শুক্রবার ২৪ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে ফিলিস্তিনি সসস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ২৪ জনের মধ্যে ১৩ জন ইসরায়েল, ১০ জন থাইল্যান্ড এবং ১ জন ফিলিপাইনের নাগরিক। গাজা ও মিসরের সীমান্তপথ রাফাহ বর্ডার ক্রসিংয়ে মিসরের সরকার এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট কমিটির (আইসিআরসি) প্রতিনিধিদের কাছে এই জিম্মিদের হস্তান্তর করা হয়েছে। ৪টি গাড়িতে এই জিম্মিদের নিয়ে আসা হয়েছিল।
জিম্মিরা মুক্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক এক বার্তায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা কেবলমাত্র জিম্মিদের প্রথম ব্যাচকে মুক্ত করতে পেরেছি। শিশু, তাদের মা এবং অন্যান্য নারীরা… প্রত্যেকে নিজেই এক একটি পৃথিবী।’
‘কিন্তু আমি ইসরায়েলের প্রত্যেক নাগরিক এবং জিম্মিদের পরিবারের সদস্যদের জোর দিয়ে বলছি, আমরা প্রত্যেক জিম্মিকে মুক্তি দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেই প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করব।’
যে ১৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪ শিশু, তাদের ৪ জন মা এবং ৫ জন বয়স্ক নারী রয়েছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশের পর এই ১৩ জনের প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষা করা হবে। তারপর পাঠানো হবে বিভিন্ন হাসপাতালে। জিম্মিদের স্বজনরা সেসব হাসপাতালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
থাইল্যান্ড-ফিলিপাইনের যেসব জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন, তাদের সবাই পুরুষ। হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের জিম্মায় থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের যেসব নাগরিক রয়েছেন, তারা সবাই পুরুষ এবং শ্রমিক। তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয় এবং পৃথক একটি সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। এই সমঝোতায় মধ্যস্থতা করবে কাতার এবং মিসর।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের হাইকমান্ড ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার কাছে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, তার ভিত্তিতেই শুক্রবার যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে গাজায়।
হামাসের সেই প্রস্তাবে গাজায় চার দিনের যুদ্ধবিরতি, উপত্যকায় ত্রাণ, জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে প্রবেশ করতে দেওয়া, আহত বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা গ্রহণে উপত্যকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি- প্রভৃতি শর্ত সহ ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির ব্যাপারটিও উল্লেখ ছিল। হামাসের হাইকমান্ড বলেছিল, ইসরায়েল যদি তার বিভিন্ন কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৫০ জনকে ছেড়ে দেয়, তাহলে নিজেদের হাতে থাকা জিম্মিদের মধ্যে থেকে ৫০ জনকে মুক্তি দিতে রাজি আছে হামাস।
প্রথমদিকে এই শর্ত আমলে না নিলেও পরে ইসরায়েলের নাগরিক, জিম্মিদের পরিবারের সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে গত ২১ নভেম্বর সেই প্রস্তাবে সায় দেয় ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা।
শুক্রবার যেদিন ২৪ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস, সেই দিনই ইসরায়েলের হাইফার দু’টি কারাগার ডেমন ও মেডিগো থেকে ৩৯ জন কারাবন্দি ফিলিস্তিনিকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করেছে ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ। মুক্ত এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ২৪ জন নারী এবং ১৫ জন কিশোর-কিশোরী।
তবে এই ৩৯ ফিলিস্তিনিকে মুক্তির আগে তাদের মধ্যে অন্তত ৩ জনের বাসভবনে ইসরায়েলি পুলিশ অভিযান চালিয়েছে বলে দাবি করেছেন একাধিক প্রত্যক্ষ্যদর্শী। তবে পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।
গত ৭ অক্টোবর ভোরে ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্ত বেড়া ভেঙে ইসরায়েলে প্রবেশ করে নির্বিচারে সামরিক-বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে তারা। সেই সঙ্গে জিম্মি হিসেবে গাজায় ধরে নিয়ে যায় ২৪২ জনকে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, এই জিম্মিদের মধ্যে ইসরায়েলিদের সংখ্যা ১০৪ জন। বাকি ১৩৮ জনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকরা রয়েছেন।
হামাসের এই হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। ১৬ অক্টোবর থেকে তাতে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে গাজায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৪ হাজার। আর গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন।
শুক্রবার যেসব ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন, তাদের একজন আদিনা মোশে (৭২)। তার পুত্রবধূ করিনে মোশে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে তিনি, তার স্বামী এবং আদিনার অন্যান্য সন্তানরা হাসপাতালে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
‘আমি তাকে খুব, খুব বেশি মিস করছিলাম। আমি তাকে ফের আমার বাসায় নিয়ে যেতে চাই। আমরা পুরো পরিবার আজ তার সঙ্গে রাতের খাবার খাব, ’রয়টার্সকে বলেন করিনে।