বৃষ্টির কারণে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। কাট-অফ টাইম ছিল ৯.৩৩, কিন্তু এর ঘণ্টাখানেক আগেও থামেনি বৃষ্টি। ফলে মাঠ খেলার উপযুক্ত না থাকায় রাত রাত ৮.৩২ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন আম্পায়াররা। যদি ৯.৩৩ মিনিটেও খেলা শুরু করা যেত তখন ম্যাচ হতো ২০ ওভারে। সেক্ষেত্রে ২০ ওভারে আইরিশদের লক্ষ্য দাঁড়াতো ১৮৫ রান। কিন্তু বৃষ্টির না থামায় সেটাও হলো না।
লিটন দাস, শান্তর ফিফটি। তারপর মুশফিকের টর্নেডো সেঞ্চুরিতে আয়ারল্যান্ডকে ৩৫০ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ। এটাই ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ।
এর আগে চলতি সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ৩৩৮ রান করে নিজের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান করেছিল টাইগাররা। তবে সেই রেকর্ড টিকলো না এক ম্যাচও। টানা দুই ম্যাচেই নতুন রেকর্ড গড়লো তামিম ইকবালের দল।
সোমবার (২০ মার্চ) শুরুতেই আইরিশ বোলারদের তোপে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। খোলস ছেড়ে বের হওয়ার আগেই আউট তামিম ইকবাল। এরপর লিটন কুমার দাস ও নাজমুল হোসাইন শান্ত মিলে প্রাথমিক চাপ সামলে গড়লেন অনবদ্য শতরানের জুটি। আর তাতে তৈরি হয় টাইগারদের বড় সংগ্রহের আদর্শ মঞ্চ।
মিডল ওভারে লিটন, শান্ত ও সাকিব দ্রুত ফিরলে কিছুটা চাপে পড়ে টাইগাররা। এরপর ব্যাট হাতে প্রথম ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। তার সেঞ্চুরিতে চাপ তো উধাও হয়েছেই, বড় সংগ্রহও পেয়েছে টাইগাররা।
এর আগে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই আয়ারল্যান্ডের বোলারদের তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। দুই ওপেনার লিটন কুমার দাস ও তামিম ইকবাল স্বাভাবিক গতিতে রান তুলতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন।
ইনিংসের প্রথম সাত ওভারে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে জমা হয় মাত্র ১৮ রান। অষ্টম ওভারে এক ছক্কা ও এক চার হাঁকিয়ে খোলস ছেড়ে বের হওয়ার ইঙ্গিত দেন লিটন। আর তাতে রানের গতিও কিছুটা বাড়ে।
এরপর তামিমের ব্যাট থেকেও আসে আরও দুইটি চার। তবে ইনিংসের দশম ওভারের শেষ বলে তামিম কাটা পড়েন রান আউটের ফাঁদে। স্কয়ার লেগে খেলেছিলেন লিটন, তবে ওই বলে লিটন বা তামিম কেউই নিশ্চিত ছিলেন না, রান হবে কিনা। দ্বিধা থাকলেও দৌড়ানো শুরু করেন, লিটন পৌছালেও তামিম পৌঁছানোর আগেই মার্ক এডেয়ারের থ্রো সরাসরি ভাঙে স্ট্রাইক প্রান্তের স্টাম্প।
আউট হয়ে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৩১ বলে চারটি চারে ২৩ রান। যেখানে প্রথম প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন তিনি।
প্রথম দশ ওভারে এক উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তুলতে পারে ৪২ রান। এরপর নতুন ব্যাটার নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে আবারও নতুন জুটি গড়ার চেষ্টা করেন আরেক ওপেনার লিটন। দারুণ সাবলীল ব্যাটিংয়ে ধীরে ধীরে নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন লিটন। আর তাতেই শম্ভুক গতিতে এগোতে থাকা টাইগারদের স্কোরবোর্ডের গতি বাড়ে চোখে পড়ার মতো। একই সাথে দ্রুত কিছু বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজের স্ট্রাইকরেটও বাড়িয়ে নেন লিটন।
লিটনকে এ সময় যোগ্য সমর্থন দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রথম ১০ ওভারে ৪২ রান তোলা বাংলাদেশ পরের ১০ ওভারে তোলে ৬০ রান। সবমিলয়ে ১২ ওভারে ৫০ পূর্ণ হওয়া স্কোরবোর্ডে ১০০ রান জমা হয় ২০তম ওভারে।
এরমধ্যে ১৯তম ওভারে লিটন মারেন এক ছক্কা ও এক চার। এরপর ২০তম ওভারে শান্তর ব্যাট থেকে আসে আরও ১০ রান। ২১তম ওভারে লিটন নিজের ফিফটি স্পর্শ করেন ৫৪ বলে। প্রথম ২২ বলে ছয় রানে থাকা এই ডানহাতি ব্যাটার পরের ৩২ বলে করেছেন ৪৮ রান।
এরপরের ওভারে লিটন মারেন এক ছয় ও শান্তর ব্যাট থেকে আসে আরও একটি চার। লিটন আর শান্তর দাপটে শুরুর সেই চাপ উধাও হয়ে যায় স্বাগতিক শিবির থেকে। ফিফটির পর যেন রানের গতি আরও বাড়াতে চান লিটন। শান্তর সঙ্গে তার জুটি পার হয় শতকের ঘর।
তবে এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি। ইনিংসের ২৬তম ওভারে দলীয় ১৪৩ রানে কার্টিস ক্যাম্ফারের শর্ট লেংথের বলে ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে শর্ট মিডউইকেটে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফেরেন লিটন। ফেরার আগে লিটনের ব্যাট থেকে এসেছে ৭১ বলে সমান তিনটি করে ছয় ও চারে ৭০ রানের ইনিংস।
এরপর সাকিব আল হাসানকে নিয়ে নতুন জুটি গড়ায় মনোযোগ দেন শান্ত। ৫৯ বলে ফিফটি স্পর্শ করেন তিনি। ফিফটির পর শান্তও আগ্রাসী ব্যাটিং শুরু করেন। আগের ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা সাকিব এদিন ব্যর্থ, ফিরেছেন মাত্র ১৭ রান করে। দলীয় ১৮২ রানে হিউমের বল উড়িয়ে মারতে গেলে হ্যারি টেক্টরের হাতে তালুবন্দি হন তিনি।
সেঞ্চুরি নাগালে থাকলেও ছুড়ে উইকেট এসেছিলেন লিটন । এবার সেই দলে যোগ দিলেন শান্তও। আইরিশ পেসার গ্রাহাম হিউমের ক্রস সিমে করা লেগ সাইডের ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়েছিলেন তিনি। সেটা ব্যাটে না লাগলেও গ্লাভস ছুঁয়ে জমা হয় আইরিশ উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। ফেরার আগে তিন চার ও দুই ছয়ে ৭৭ বলে ৭৩ রান করেন তিনি।
৮ রানের মধ্যে সাকিব ও শান্তকে হারিয়ে আচমকাই টাইগারদের রানের গতি কমে যায়। এরপর দুই নতুন ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও তাওহীদ হৃদয় মিলে নতুন জুটি গড়ে পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। আগের ম্যাচে আগ্রাসী ইনিংস খেলা মুশি আজও ছিলেন আক্রমণাত্মক।
মুশির আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন আগের ম্যাচে দুর্দান্ত ফিফটি করে হৃদয়। ৩৬-৪০, এই ৪ ওভারে ৩৯ রান যোগ হয়েছে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে। সবমিলিয়ে ৪০ ওভার শেষে টাইগারদের স্কোর দাঁড়ায় চার উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান।
৪৩তম ওভার করতে আসা মার্ক অ্যাডায়ের এক ওভার থেকে মুশফিক একাই আদায় করেন দুই চার ও এক ছক্কায়। এই ওভারেই ফিফটি পূর্ণ করেন মুশি, যেটা আসে ৩৩তম বলে। আগের ম্যাচে ঝোড়ো ব্যাটিং করলেও ফিফটি পাননি, আজ সে আক্ষেপ মিটল তার।
ফিফটির পর যেন আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন মুশফিক। ব্যাট হাতে তার তাণ্ডবে রীতিমতো খেই হারিয়েছে আইরিশা বোলাররা। তার দাপটে আড়াইশো থেকে তিনশো পৌঁছাতে বাংলাদেশের লেগেছে মাত্র ১৯ বল।
আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে স্রেফ ৬৩ বলে ১০০ রান যোগ করেন মুশফিকুর রহিম ও তাওহিদ হৃদয়। ইনিংসের ৪৫ ওভারেই তিনশ পার হয় বাংলাদেশের দলীয় সংগ্রহ। মুশিকে যোগ্য সঙ্গ দেওয়া হৃদয়ের ‘হৃদয়’ ভাঙে দলীয় ৩১৮ রানে, ফিরে যান ব্যক্তিগত ৪৯ রান করে।
শেষ ওভারের তৃতীয় বলে যখন স্ট্রাইকে যান মুশফিক, তখন তার সংগ্রহ ৫৬ বলে তাঁর রান। ওই বলে ডাবলসের পর গ্রাহাম হিউমকে রিভার্স স্কুপে চার মেরে সেঞ্চুরিকে আনেন আরও কাছে। পরের বলে ওয়াইড লং অনে খেলে আবার ডাবলসে মুশফিক পৌঁছে যান ৯৯ রানে।
এরপর ইনিংসের শেষ বলে মিডউইকেটে ঠেলে দিয়ে মুশফিক মাতেন উল্লাসে, যে উল্লাস রেকর্ডগড়া সেঞ্চুরির। ৬০ বলেই সেঞ্চুরি পেলেন মুশফিক, বাংলাদেশের হয়ে যেটি এখন দ্রুততম। এক্ষত্রে মুশফিক ভেঙেছেন সাকিব আল হাসানের রেকর্ড ৬৩ করা সেঞ্চুরির রেকর্ড। শেষ পর্যন্ত মুশির তাণ্ডবে ৫০ ওভার শেষে টাইগারদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ছয় উইকেট হারিয়ে ৩৪৯ রান।