ড্রাইভার উচ্চস্বরে ডাকছে— ‘হফার! হফার! হফার!’ কাঁধব্যাগটি হাতে নিয়ে সিএনজির পেছনে বসতে যাব এমন সময় এক তরুণী এসে জিজ্ঞেস করলো—চত্বর যাবেন? ড্রাইভার একটু তাচ্ছিল্যের স্বরেই বললেন—অয়। আমি মেয়েটিকে আগে ওঠার জন্য চোখেমুখে ইশারা করলাম। মেয়েটি ম্লান হাসলো। আবছা আলোয় সে হাসির নহরাও বিদ্যুৎবেগে আমাকে বিমোহিত করে।
মেয়েটি এক সাইড হয়ে বসে। আমিও তার পাশে। অন্য যাত্রীদের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি। কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তবু ভাবছি—সে উত্তর দিবে কিনা! এ বয়েসে এসেও আমার ভেতরের সত্ত্বাটি এখনো ইন্ট্রুভার্টই রয়ে গেলে! এভাবে মিনিট দুয়েক চলে গেল। সেও হয়ত কিছু একটা ভাবছিলো। আমি মোবাইলে নেট অন করি। অ্যানড্রয়েডের যুগ বলে কথা! এক মিনিটও কী আর বৃথা নষ্ট করা যায়! মিনিট চারেকের মধ্যেই অপরাপর যাত্রীরা এসে শূন্যস্থান পূরণ করে দিলো।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে আরও মিনিট দুয়েক অতিবাহিত হলো। করিমউল্লাহ মার্কেটের সামনে প্রচণ্ড জ্যাম। আমরা জ্যাম মুক্তির অপেক্ষায় সময় গুণছি। সিএনজি ড্রাইভার সামনের রিকশাওয়ালাকে একটু বামে সাইড করতে বললো। কিন্তু রিকশা ড্রাইভার সে কথাতে খুব একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। সিএনজি ড্রাইভার পরপর দুইবার বলার পরই তার মোটিভ পরিবর্তন হয়ে গেল। এরমধ্যে জ্যামও ছাড়লো।
কী মনে করে সিএনজি ড্রাইভার তার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সোজা রিকশার পেছনে ধাক্কা দিলো। আর যাবে কোথা? রিকশাওয়ালা তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলো। মুহূর্তেই মৌখিক যুদ্ধ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মতো রূপ নিতে লাগলো! আশেপাশে মানুষ জমতে লাগলো। বিশেষ করে সিএনজি ড্রাইভাররা এক হতে লাগলো। শহরগুলোতে এই একটা মারাত্মক ঐক্য!
আমার পাশে বসা মেয়েটি সিএনজি ড্রাইভারকে বলছে—আপনিই তো দোষ করেছেন! সিএনজি ড্রাইভারের চোখের চাহনি আর ভাবমূর্তি দেখে আমি কৌশল করে মেয়েটির বাম হাতে একটু চাপ দিয়ে ক্ষীণস্বরে বললাম—একটু চুপ থাকুন। মেয়েটির নিরাপত্তা নিয়ে আমি শঙ্কিত হতে থাকি। রিকশাওয়ালার চেয়েও মেয়েটি এখন নিরাপত্তাহীন! সিএনজি ড্রাইভারের শক্তি ক্রমশই বাড়ছে। কেননা, তার চিল্লাচিল্লিতে আশেপাশের অনেক সিএনজি ড্রাইভারই এগিয়ে এসেছে। আর সে কারণেই এখন, সিএনজি ড্রাইভারের দেহের আয়তনের চেয়েও যেনো বেশি শক্তি তার শরীর বেয়ে উপচে পড়ছে! আর অপরাপর ড্রাইভাররাও অন্ধভাবেই সিএনজি ড্রাইভারের পক্ষ নিয়ে কূল রক্ষা করছে।
এরইমধ্যে কেউ কেউ মেয়েটিকে ধমকের স্বরে কথা বলা শুরু করেছে। আমি সিএনজি ড্রাইভারকে বললাম—’ওস্তাদ বাদ দিলাউক্কা! তাইন বুজচ্ছইন না! এবলা গাড়ি ছাড়ইন। জ্যাম নাই।’
সব ড্রাইভাররাই ওস্তাদ কথায় বেশ মোহিত হয়। চুম্বকের আকর্ষণে যেমন লোহা আবেশিত হয় ঠিক তেমনই আরকি! সিএনজি চলছে। সবাই নীরব। একটু পর নীরবতা ভেঙে আমিই জিজ্ঞেস করলাম—জব করেন?
—হুম।
—কীসে আছেন?
—ব্যাংকে।
—কোন ব্যাংক?
—কৃষি ব্যাংক।
—কোথায়?
–হবিগঞ্জ।
এভাবে কথা চলতেই থাকে। কথা বলতে বলতে কখন যে গোলচত্তর এসে পৌঁছেছি টেরও পাইনি। ডাইভার বলছে—ভাই গাড়ি আর যাইত নায়। নামি যাউক্কা। আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার তো নামার কথা উপশহর পয়েন্টে! দূর শালা! নিজেকেই নিজে শতবার গালি দিতে ইচ্ছে করছে। আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। কিন্তু তখনও সিএনজি ড্রাইভার মেয়েটির দিকে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
মনে হলো এতক্ষণে মেয়েটি একটু ভয়ই পাচ্ছে। পাছে আরও কোনো বিপদ হয় সে জন্যই সে আমার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকালো। আমাকে ভয়ার্ত-বিনয়ের স্বরে বললো—আমাকে একটু রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবেন? মেয়েটির কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর আর অসহায় মুখ দেখে না করার সাহস পেলাম না। আমি বললাম—মেইন রাস্তা দিয়ে গেলে টার্মিনালে জ্যামে পড়বেন। পনেরো থেকে বিশ মিনিট বা তারও উপরে সময় লাগতে পারে। আর সোজা পশ্চিমের রাস্তায় গেলে সাত/আট মিনিট লাগবে সর্বোচ্চ! বলুন, কোনদিকে গেলে আপনার সুবিধা হবে? সে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললো—সামনের রাস্তা দিয়েই চলুন, সোজাই যাই।
সোজা রাস্তাটি খুবই নির্জন। রাস্তাটি ভাঙাচোরা হওয়ায় এ রাস্তা দিয়ে রিকশা খুব একটা চলে না বললেই চলে। দুজনেই হাঁটছি। ঠিক রেললাইনের মতো। সমান্তরাল দূরত্বে! আবছা অন্ধকার। কারও মুখের সৌন্দর্যই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কেবল অডিয়োর মতো কথা শুনে যাচ্ছি!
রেললাইনের অদূরেই মিটিমিটি আলোর ঝলক দেখতে পেলাম। শব্দহীন অথচ খুব দ্রুত সে আলোর কণিকাগুলো আমাদের দিকেই আসছে। মেয়েটি একটু ভড়কে গেল! তার চোখেমুখে ভয়ার্ত ছাপ ফুটে উঠেছিলো কিনা অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না! তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তা টের পেলাম। সহসা সে আমার বাম হাত চেপে ধরে। বিপদরক্ষার্থে পরিচয়হীন লোকের হাতও যে পরম নির্ভরতায় ধরা যায়, এ আমার আগে জানা ছিলো না। অবশ্য হাত ধরার অর্থ স্থান-কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কখনোবা নির্ভরতার, কখনো ভালোবাসার, আবার কখনো স্নেহের, আবার কখনোবা আত্মরক্ষার শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়, আরও কত কী!
আলোর কণিকাওয়ালারা দ্রুত সামনে চলে আসে। আমাদের কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের একজন চাকু বের করে শক্ত গলায় বলে—যা আছে বের কর। নতুবা চাকু দিয়ে পেট নামিয়ে দিব।
এমন বিপদে আমি ইতোঃপূর্বে কখনোই পড়িনি। মেয়েটি আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে। মনে হলো আমি ওর জনম-জনমের বন্ধু! অথচ এখনঅব্দি কেউ কারো নামটি পর্যন্ত জানি না!
জীবনের অনেক ঘটনাই থাকে অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। অনেক ঘটনাই মেনে নেওয়ার মতো নয়, তবু মেনে নিতে হয়। আসলে জীবন যেখানে যেমন।
দুইজন আমার পেছনে চলে এলো, দুইজন সামনে। লোডশেডিংয়ের কারণে এই ভয়ংকর মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি না বলে একটু খারাপই লাগছে। পেছন থেকে একজন কর্কশকণ্ঠে বলে— ‘জোরে সাউন্ড খরলে জানে মারিলাইমু।’ কথাটি শোনামাত্রই হয়ত মেয়েটির চোখমুখ শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে! জমাটবাধা অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু যা ঘটলো তাও আমাকে কম বিস্মিত করেনি। পরম নির্ভরতায় সে আমার পুরো বাহুই জড়িয়ে ধরলো।
আমি একটু গড়িমসি করছি। মেয়েটি অসহায়ভাবে বলে—আমার কাছে হাজার তিনেক টাকা আছে। আর কিছু নেই। সামনের হাতির মতো মোটা লোকটি চেঁচিয়ে বলে—তাড়াতাড়ি বের কর। আমাকে ইঙ্গিত করে অপরজন বলে— ‘*মারানির ফোয়া! মানিব্যাগ বার করছ না খেনে?’
অন্যকোনো স্থানে হলে ঠিকই ভয় লাগতো। বিশেষ করে ঢাকায় বা সিলেটের বাইরে অপরিচিত কোনো স্থানে। এখানে ঠিক ভয় পাচ্ছি না, তবে স্বস্তিও পাচ্ছি না! আবার এ-ও ভাবছি—একবার দুই ঘা মেরে যদি অন্ধকারে পালিয়ে যায় তবে কে কার টিকিটি খুঁজে পাবে? মেয়েটির ভ্যানিটি ব্যাগ বের করার আগে আমিই আমার পকেটে হাত ঢুকাই। সামনের ত্রাশ সৃষ্টিকারী মোটা লোকটি ভয়ানকস্বরে গালি দিয়ে বললো— ‘হালার ফোয়া, অত দিরং লাগে খেনে? দেখছত নি? পেটবাইদি এখবারে হান্দাই দিমু!’
আমি রসিকতার ছলে বলি— ‘ভাই, দেখা যার না তো।’ একজন মোবাইলের টর্চ আমার প্যান্টের পকেটের দিকে তাক করে। আমি প্যান্টের পকেট থেকে থাইল্যান্ডি মালটি আংশিক বের করতেই সামনের হাতিমার্কা লোকটি চিৎকার করে বললো—Go back, quick।
এরপর কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা সদলবলে ঝড়ের গতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। মেয়েটি ততক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আনন্দে, স্বস্থিতে না ভয়ে, নাকি রোমান্সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে এমন পরিস্থিতিতে যে রোমান্সের মুড থাকে না এ ধ্রুব সত্য। অন্ধকার না থাকলে হয়ত তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিকও দেখতে পেতাম। হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে এলো। হায়রে! বেরসিক বিদ্যুৎ—শামসুর রাহমানের মতো স্থান-কাল-পাত্রও বুঝিস না!
সেকি! মেয়েটির চোখ ভেজা! আমি দুহাত দিয়ে তার চোখ মুছে দিই। বিদ্যুৎ আসায় সহসা সে আমার চোখের দিকে যেনো আর তাকানোর সাহস পাচ্ছিলো না। পুরোটাই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অবিশ্বাস্য! নিজের হাতেই চিমটি কাটি। না, ঠিকই তো আছি। তবে? আমি তার চিবুকের কাছে মুখ নিয়ে বললাম—আর ভয় নেই। চলুন।
সে একবার ম্লান হাসার চেষ্টা করলো। তারপর সামনের দিকে পা বাড়ালো। দুজনেই চলছি। সে আমাকে বললো—আপনি যদি আজ না থাকতেন…! আমি রসিকতা করে বললাম—আপনি হয়ত তখন এ রোডেই আসতেন না!
এরপর অনেক কথাই হলো। দেখতে দেখতে আমার বিদায়ের ঘণ্টাও বেজে গেল। সে একটু ইতস্তত করে বললো—যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলবো। —জি বলুন। —আচ্ছা, আপনি কি সবসময়ই অস্ত্র সাথে রাখেন?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম—হ্যাঁ। সৎসাহসই আমার অস্ত্র! তবে আজকে যে অস্ত্র দেখে তারা লেজগুটিয়ে পালালো সেটি সত্যিকারের অস্ত্র না! মেয়েটি বিস্মিত দৃষ্টিভঙ্গিমায় বললো—মানে?
মানে খুবই সোজা। আগামীকাল আমার এক শিশুছাত্রের জন্মদিন। এই থাইল্যান্ডি খেলনা পিস্তলটি তার বার্থডে উপলক্ষ্যেই কিনেছি। কথাটি শেষ হওয়ামাত্রই মেয়েটি হো হো করে হেসে ওঠলো।
কী যে সে বিস্ময়কর হাসি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—“সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই”।
এ যে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের ফেরিওয়ালা! আমিও তার হাসির সমুদ্রে অবগান করতে থাকি। সে হাসির সমুদ্রে একবার অবগাহন করলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না।