আপনারা যারা ছোটখাটো কিংবা বড় পদ-পদবী নিয়ে দল ক্ষমতায় তাই বিশাল মুজিবপ্রেমী, তাদের জানা থাকা প্রয়োজন জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করার পরে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী খুনী মোশতাক দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলে ১৯ জন আওয়ামী লীগ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য মোশতাকের মন্ত্রী সভায় যোগ দেয়।
বিএনপির সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক হোন। ছয় দফা দাবীর আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে অনেকের মতো তারও মতামত ছিলো ‘শেখ মুজিব যখন জেলে তখন আমি বাইরে থাকতে পারি না’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে কালবিলম্ব না করে তিনি মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। একজনের কথা বললাম। কিন্তু এমন চরিত্র অসংখ্য।
ওসমানী আগে থেকেই সব জানতেন এবং মোশতাক সরকারের আনুগত্য গ্রহণ করে মন্ত্রী পদমর্যাদায় মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা হোন। খালেদ মোশাররফ বা অন্যদের নিভৃত করেন পাল্টা অভ্যুত্থান থেকে।
সামান্য পদ পদবী, পোস্টিং, প্রমোশন, ব্যবসা কিংবা সামাজিক প্রভাবপ্রতিপত্তি পাবার উদ্দেশ্য প্রোফাইলে কিংবা কাভারে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কিংবা লোক দেখানো ফুলমাল্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে যারা জাতির জনকের প্রতি ভালবাসা দেখায় তারা কি তার চিন্তা, দর্শন আর জীবন থেকে শিক্ষা নেয় কিনা সেটাই এসময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী খুনী ফারুক রশীদদের প্রতি সমর্থন দেন। এমনকি হাত তুলে দোয়া করেছেন বলেও শোনা যায়। সেই সময়ের পিজি হাসপাতাল মানে বর্তমানের শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্দকার মোশতাকের সাথে একটা বৈঠক করার জন্যে মাওলানা ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত আলোচনাও হয়েছিলো।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের এ উক্তি এবং ঘটনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে। জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কী হয়েছে?’ শাফায়াত বললেন, ‘অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ এ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।’ তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’
এছাড়া এন্থনি ম্যাসক্যারেনাস এর নেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনীর খুনী চক্র জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলে যে “তিনি সব জানতেন এবং বলেছিলেন তোমরা জুনিয়ররা যদি কিছু করতে চাও, করো।”
সেই সময়ের সেনা প্রধান সফিউল্লাহকে বঙ্গবন্ধু ফোন করেছিলেন। তার বর্ণনাটি এমন ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সফিউল্লাহ! তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ ফোনেও ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?’
সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতিকে বাসা থেকে পালিয়ে যেতে বলেছেন এবং পরবর্তীতে তিনি বলেন, সে সময়ে তিনি ব্যাবস্থা নিলে নাকি তিনিও মারা যেতেন। এই হলো সেনাপ্রধানের ভূমিকা। মৃত্যুকে ভয় পায় এমন সেনাপ্রধান পৃথিবীর ইতিহাসে কমই আছে।
রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার যে শপথ নিয়েছিলো তা ভুলে ভয় পেয়ে সেনাবাহিনীর সাথে দেন দরবার করছিলো নিজেদের রক্ষা করার জন্যে। রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সে সময় দেশে ছিলেন না। রক্ষীবাহিনীর উপরের সারির দুজন কর্মকর্তা মোশতাককে সমর্থন দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এমন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সরকারকে আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়।
১৯৭৫ সালে ডিজিএফআইএর মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট, বেঙ্গল ল্যান্সারস্ আর মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট। দুটি ইউনিটই ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মাস দুয়েক আগে অজ্ঞাত কারণে ৪৬ ব্রিগেডের একমাত্র গোয়েন্দা ইউনিট প্রত্যাহার করে সেনা হেডকোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
সেই সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব এবং পুলিশের আইজির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বিমানবাহিনী প্রধান এবং নৌ-বাহিনী প্রধানের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারাও মেনে নিয়েছিলো। সুশীল সমাজ, সাংবাদিকবৃন্দ কিংবা বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জাসদের নেতৃবৃন্দ টু শব্দটি করেনি। কর্নেল তাহেরকে দেখা যায় রেডিও স্টেশনের কোনায়।
বাকশালের ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম প্রথম প্রতিবাদ করেন বলে জানা যায়। জাতীয় চার নেতাসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। অনেকে ভারতে পালিয়ে যায়। খালেদ মোশাররফ এর ক্ষমতা দখলের সময় তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং তার মা এর নেতৃত্বে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে মিছিল বের হয়েছিলো ঢাকার পথে। কাদের সিদ্দিকী মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।
সামান্য পদ পদবী, পোস্টিং, প্রমোশন, ব্যবসা কিংবা সামাজিক প্রভাবপ্রতিপত্তি পাবার উদ্দেশ্য প্রোফাইলে কিংবা কাভারে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কিংবা লোক দেখানো ফুলমাল্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে যারা জাতির জনকের প্রতি ভালবাসা দেখায় তারা কি তার চিন্তা, দর্শন আর জীবন থেকে শিক্ষা নেয় কিনা সেটাই এসময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
জাসদের স্বাপ্নিক বিপ্লব ও অদূরদর্শীতা, সর্বহারা সিরাজ সিকদার, বিদেশি শক্তির হাতের পুতুল রাজনীতিবিদরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের অপেশাদারিত্ব, মিথ্যা বানোয়াট হলুদ সাংবাদিকতা, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্র, আন্তর্জাতিক অস্থিরতা এবং ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগের ভিতরের কোন্দল আর ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ সবই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো।
দল ক্ষমতায় না থাকলে বা পাশার দান উল্টো হয়ে গেলে অনেকের চরিত্রই প্রকাশ পাবে। এত শত সহস্র বঙ্গবন্ধু প্রেমীদের অনেককে হয়তো তখন শেখ কামালের নামে বানানো ব্যাংক ডাকাতির বানোয়াট উদ্দেশ্যেপ্রনোদিত গল্প বলতে শুনবো।
সকল ষড়যন্ত্রের মুখোশ উম্মোচিত করে বস্তুনিষ্ঠ সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা খুব জরুরি।
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জাতির জনকের প্রতি। কাঁদো বাঙালি কাঁদো।
- ডা. মোহাম্মদ হাসান। চিকিৎসক এবং পেশাজীবি সংগঠক।