ব্রিটেনে ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনায় উদ্বেলিত ভারত

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে– আর তাকে ঘিরে ভারতেও তুমুল আগ্রহ, উদ্দীপনা আর মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে। বরিস জনসনের উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে ঋষি সুনাক যতই এগোচ্ছেন, ততই তাকে নিয়ে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা বাড়ছে, গুগলে বা টুইটারে কোটি কোটি ভারতীয় তাকে সার্চ করছেন। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও অধীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য রাখছে, সুনাক শেষ পর্যন্ত সত্যিই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছতে পারেন কি না।

কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব দখলের লড়াইয়ে ব্রিটেনের সাবেক অর্থমন্ত্রী সুনাক বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) দ্বিতীয় রাউন্ডেও বাকি সবাইকে পেছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। এই দফাতে তিনি পেয়েছেন সর্বাধিক ১০১টি ভোট, আর ৮৩টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে এসেছেন পেনি মরডন্ট। ব্রিটিশ মিডিয়াও সুনাককেই এই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রিত্বের মূল দাবিদার বা ‘ক্লিয়ার ফ্রন্টরানার’ হিসেবে চিহ্নিত করছে।

ভারতের নামী শিল্পপতি ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার আনন্দ মাহিন্দ্রা এরপরই একটি মজার ছবি টুইট করেন – যেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন টেন ডাউনিং স্ট্রিটকে হিন্দু রীতিতে ফুল, বেলপাতা আর পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্ন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঠাট্টা করে তিনি লেখেন – ‘এই কি টেন ডাউনিং স্ট্রিটের ভবিষ্যৎ?’ সেখানে কমেন্ট পড়েছে হাজার হাজার।

টুইটে ঋষি সুনাকের নাম না-নিলেও আনন্দ মাহিন্দ্রা কী বোঝাতে চেয়েছেন তা ছিল স্পষ্ট। বস্তুত ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের সদস্য হিসেবে ঋষি সুনাক শপথও নিয়েছিলেন হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভাগবতগীতায় হাত রেখে। তিনি যে ধর্মবিশ্বাসে একজন হিন্দু, সে কথা কখনও গোপন করেনি। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন এবং তিনি গীতা স্পর্শ করে শপথ নিয়েছিলেন – এই বার্তাও ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তুলেছে।

তবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট আশা জাদেজা মোটওয়ানি সাবধান করে দিয়ে বলছেন, ‘ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে কিন্তু এশিয়ান বা দক্ষিণ এশিয়ান অরিজিন বলেই বর্ণনা করা হবে। নিশ্চিত থাকতে পারেন, ব্রিটেনে কেউই তাকে হিন্দু প্রধানমন্ত্রী বলবেন না।’

সুনাকের বাবা যশবীর ও মা ঊষা – দুজনেরই জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে, ভালো কাজের সুযোগে ও পড়াশুনোর জন্য তারা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। যশবীর সুনাক ব্রিটেনে একজন জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) ডাক্তার হিসেবে ও ঊষা সুনাক ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। মেধাবী ছাত্র সুনাক আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমবিএ-ও করেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুনাক ব্রিটেনের চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার (অর্থমন্ত্রী) হন। সুনাকের আর একটা পরিচয় হল, তিনি ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি ও ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তির জামাতা। নারায়ণমূর্তির কন্যা অক্ষতার সঙ্গে তার আলাপ স্ট্যানফোর্ডেই, পরে তারা দু’জনে বিয়ে করেন।

সুনাক অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনই জানাজানি হয়, তার স্ত্রী অক্ষতা ট্যাক্সের কারণে ‘নন ডমিসাইলড’ – অর্থাৎ বিদেশে তার উপার্জিত অর্থের জন্য তিনি ব্রিটেনে কোনও আয়কর দেন না। যদিও এর মধ্যে বেআইনি কিছু নেই, তবু ঋষি সুনাকের রাজনৈতিক কেরিয়ারে তা বিরাট অস্বস্তি বয়ে এনেছিল।

সুনাক প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নামার পর গত সপ্তাহে তার বাড়ির সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জন্য ট্রে-তে করে নিজের হাতে চা-কফি এনে দিয়েছিলেন অক্ষতা সুনাক।

ভারতের আর একজন নামী সাংবাদিক বীর সাংভি আবার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ব্রিটেনের রাজনীতিতে ঋষি সুনাকের উত্থান এটাই প্রমাণ করে যে সে দেশের গণতন্ত্র কতটা পরিণত (ম্যাচিওরড)। ‘কানাডায় শিখ রাজনীতিবিদরা গুরুত্ব পেলেও সেখানে এথনিক ভোট টানার জন্যই তাদের ব্যবহার করা হয়। ব্রিটেনে কিন্তু ঋষি সুনাক বা সাজিদ জাভিদকে কেউ ভারতীয় বা পাকিস্তানি ভোট টানার জন্য প্রোমোট করেনি, এটাই তাদের বিশেষত্ব।’

ভারতীয় মিডিয়া বিদেশে যখন ভারতীয়দের সাফল্য খোঁজে, তখন মূলত বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী বা টেক-হুইজ কিডদের দিকেই তাকায় – কিন্তু বিদেশের রাজনীতিতেও যে তারা সফল হতে পারেন ঋষি সুনাক তারই একটা দৃষ্টান্ত বলে বীর সাংভি মন্তব্য করেছেন। ভারতে অজস্র লোক তার এই পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করছেন।

ভারত সরকারও অধীর উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে সুনাক শেষ পর্যন্ত সত্যিই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন কি না, সে দিকে। ‘সুনাক প্রধানমন্ত্রী হলেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতি প্রবলভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকবে, এরকম কোনও অলীক প্রত্যাশা মোটেও ভারতের নেই। তবে দু’দেশের মধ্যে বহুপ্রতীক্ষিত যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) নিয়ে আলোচনা চলছে, সেটা দারুণ গতি পাবে বলেই আমরা আশা করছি’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা।

এই মুহুর্তে ঢাকায় যিনি ভারতের হাই কমিশনার, সেই বিক্রম দোরাইস্বামী অচিরেই লন্ডনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা ও দৌত্যের ভার তাকেই তখন অনেকটা সামলাতে হবে।