দ্রুতগতির গাড়িটা আঁকাবাঁকা পথের আরেকটা মোড় ঘুরতেই দেখি অনেকগুলো মোটরসাইকেল দিয়ে রাস্তা আটকানো। একদল যুবক এলোমেলো দাঁড়িয়ে। গাড়িচালক ব্রেক কষতে বাধ্য হলেন। আমার মনে খটকা। রাস্তাটা নির্জন বনের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু এই রাস্তায় ডাকাতি-ছিনতাই তো অতীত ইতিহাস। গাড়িঘোড়া, যাত্রীসাধারণ, দেশি-বিদেশি পর্যটক দিনরাত যাতায়াত করছে নিরাপদে। তাহলে এরা কারা!
পেছনের সিট থেকে মোস্তাফিজ বলে উঠলেন, সিরাজ ভাই, আপনার ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা ঘিরে ধরেছে। একটু কষ্ট করে নামেন। যুবকদল ততক্ষণে গাড়ির কাছে এসে পড়েছে। খেয়াল করে দেখি, অনেকের হাতে ফুলের তোড়া। মুখে বিজয়ের হাসি। চেহারায় উপচে পড়া উচ্ছ্বাস। ওরা ধরাধরি করে সিরাজ ভাইকে নামালেন। কার আগে কে ছোঁবে, ঠেলাঠেলি অবস্থা। পিছে পিছে আমরাও নামলাম। হাসি-আনন্দ-উল্লাসে মুখর বুনোপথ। ‘সিরাজ ভাই, এই সম্মাননা আমরার’, এতোদিন পর সিরাজ ভাইয়ের যোগ্য মূল্যায়ন’ ‘কমলগঞ্জ আজ ধন্য, ‘আমরা আজ গর্বিত’- একেকজনের মুখে একেক প্রশংসাবাক্য। সিরাজ ভাইয়ের হাতে ফুলের তোড়া দেওয়া, ছবি তোলা, ভিডিও করা- ফটোসেশনের ধুম। তারপর ‘সিরাজ ভাইয়ের বিশ্বজয়’ শ্লোগান তুলে আমাদের গাড়িকে মোটরসাইকেলবহরে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে নিয়ে চললো স্থানীয় সাংবাদিকদের দলটি। কিছুদূর গিয়ে সোজা ঢোকানো হলো উপজেলা সদরের মুখেই পৌরসভা অফিসে। সেখানে নিয়ে আরেক কারবার। হই-হুল্লোড়, মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ি, ভাববিনিময় শেষে তাৎক্ষণিক আয়োজনে হয়ে গেল একটা মিনি সংবর্ধনা পর্ব। গর্বে বুক ফুলিয়ে, আবেগে কেঁপে কেঁপে, উচ্ছ্বাসে চোখ ভিজিয়ে বক্তারা বইয়ে দিলেন শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বন্যা। একজন তো রাস্তায় দেওয়া শ্লোগানটাকে একদম উল্টে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, ‘কিসের সিরাজ ভাইয়ের বিশ্বজয়! এই ঘটনা আসলে ‘বিশ্বের আহমদ সিরাজজয়’। ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। সেসব পরে বলছি। আগে কী সেই শ্লোগান-উল্টানো ঘটনা, প্রথম থেকে বলি :
দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ডেইলি সান পত্রিকা, নিউজ টুয়েন্টিফোর ও টি স্পোর্টস টেলিভিশন, রেডিও ক্যাপিটাল এবং বাংলা নিউজ অনলাইন পোর্টালসহ দেশের অন্যতম প্রধান গণমাধ্যমগোষ্ঠী ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ-এর সত্ত্বাধিকারী দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করেছে ‘বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২১’। এর প্রধান পর্ব ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিতার প্রতিযোগিতা। শক্তিশালী বিচারকমণ্ডলীর মাধ্যমে সারা দেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া থেকে ৫টি ক্যাটাগরিতে অংশ নেওয়া প্রায় ৩০০ জন অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের মধ্য থেকে ১১ জনকে সেরা নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রত্যেক বিজয়ীকে দেওয়া হয়েছে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ইত্যাদির সঙ্গে আড়াই লক্ষ এর টাকা।
এই পুরস্কারের পাশাপাশি বসুন্ধরা গ্রুপ একই মঞ্চে আয়োজন করেছে দেশের ৬৪ জেলা থেকে জীবনভর তৃণমূল সাংবাদিকতায় প্রাণপাত করা ৬৪ জন গুণী সাংবাদিককে সম্মাননা প্রদানের এক মহতী উদ্যোগ। তাঁদেরও প্রত্যেককে ঢাকায় যাতায়াতের খরচ দিয়ে, তিন তারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে মঞ্চে নিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে ক্রেস্ট, সনদ, এক লক্ষ টাকার পে-অর্ডার উপহারসহ সম্মাননা দেওয়া হয়। এই অনন্য আয়োজনে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার গুণী সাংবাদিক হিসেবে নির্বাচন করা হয় আহমদ সিরাজ, সবার প্রিয় সিরাজ ভাইকে।
মৌলভীবাজার জেলায় আমি নবাগত। থাকি কমলগঞ্জ উপজেলায়, সিরাজ ভাইয়ের বাসস্থানের অনতিদূরেই। হয়তো এখানে আমি অনাহূত বহিরাগতর মতো। তবে প্রতিবেশীরা আমাকে ‘মেহমান’ সমাদরেই সহ্য করে আসছেন প্রায় আড়াই বছর ধরে। এখানকার মহান-মহৎ অনেক কিছুর মতো আহমদ সিরাজকেও চিনতাম না, জানতাম না। শুধু শুনতাম, একজন সাদা মনের আর বর্ণিল গুণের লেখাপাগল মানুষ এই সিরাজ ভাই। তাঁর কথা শোনার আগে আমার কমলগঞ্জবাসের প্রথম দিককার একটা ঘটনা। পদ্মছড়া চা বাগানের উত্তরে টিলাগাঁও গ্রামের একটা টিলায় উঠেছি প্রকৃতি দর্শনে। গ্রামবাসীর সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে একজন মুরুব্বি বললেন, ‘আমাদের সাংবাদিক সিরাজকে তো চেনেন।’ আমি একটু ইতস্ততত করে বললাম, ‘কোন সিরাজ?’ মুরব্বি বললেন, ‘আহমদ সিরাজ! অনেক বড় সাংবাদিক।’ আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘না ভাই, চিনি না যে!’ মুরব্বি বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘সে কী! আপনি ঊনত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিকতা করেন ঢাকায়; শুনছি, বড় বড় পত্রিকায় বড় বড় পদে চাকরি করছেন, আর আহমদ সিরাজকে চেনেন না?’
আমি যেন ধপাস করে পড়লাম টিলা থেকে। লজ্জায়, হতাশায় লাল, নীল, ফ্যাঁকাসে, অবশেষে কালোমুখ হয়ে বাসায় ফিরলাম। ঘরে বসে ভাবছি আর ভাবছি। হঠাৎ মনে পড়লো, অনেক বছর আগে, তখন কাজ করি প্রথম আলোয়। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে লিখি। প্রথম দিকেই একবার এসেছিলাম সিলেট বিভাগ সফরে। তখন মৌলভীবাজারের প্রথম আলোর সাংবাদিক আকমল হোসেন নিপুর মুখে একবার শুনেছিলাম আহমদ সিরাজের কথা। পরে আর তাঁর কাছে যাওয়া হয়নি বলে হয়তো ভুলে গেছি।
ওইদিন লজ্জায় ‘টিলাপাতিত’ হওয়ার পরে স্থানীয়দের কাছ থেকে সবিস্তারে জানলাম, শুনলাম আহমদ সিরাজ নামের মাহাত্ম্য। কমলগঞ্জের সাংবাদিকমহলে তিনি দেবতার আসনে। দলিত-অবহেলিত সম্পদ্রায়ের কাছে দরদী বন্ধু। সাধারণের কাছে জীবন্ত কিংবদন্তি। গোটা জেলাবাসীই তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত।
এমন মানুষই তো খুঁজে বেড়িয়েছি জীবনভর। এমন সিরাজ ভাই-বোনদেরই তো সন্ধান করে ফিরেছি, লিখেছি, লিখতে চেয়েছি সংবাদপত্রের পাতায়। আর হাতের কাছে থাকা সেই মানুষের কথা এতোদিন জানতেই পারিনি! ঠিক করলাম, দুই-এক দিনের মধ্যেই দৌড়াবো আহমদ সিরাজ-দর্শনে। কিন্তু কোত্থেকে এসে থামিয়ে দিল মড়ার করোনা। নিজেও একমসয় আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। হয়ে গেলাম গৃহবন্দি। করোনা-প্রকোপ কমে এলেও আমি আর বেরনোর সাহস পাই না, শক্তিও পাই না। সিরাজ ভাইয়ের কাছেও যাওয়া হয় না। একদিন মোস্তাফিজ এসে বললেন, সিরাজ ভাই নিজেই নাকি আমার বাসায় আসতে চান। আমি জিহবা কামড়ে বললাম, ‘সর্বনাশ! এটা কখনোই উচিত হবে না। এমন গুণী মানুষকে আমি আগে দেখতে যাবো; তারপর আমিই তাঁকে নিয়ে আসবো।’ কিন্তু অলসদের যা হয়, সেই যাওয়া আর হয়েই উঠলো না। অবশেষে সুযোগ এনে দিলো বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড।
আহমদ সিরাজকে নির্বাচন করা হয়েছে মৌলভীবাজার জেলার গুণী সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা প্রদানের জন্য। তাঁকে নিয়ে যেতে হবে ঢাকায়। বসুন্ধরার সঙ্গে আমিও একদিন যুক্ত ছিলাম। তাদের মিডিয়া গ্রুপের দৈনিক কালের কণ্ঠে দীর্ঘ সাড়ে ১০ বছর সাংবাদিকতা করেছি আমি। তার আগে আরো সাড়ে ১০ বছর করেছি প্রথম আলোয়। আরো আগে ভোরের কাগজে। তারও আগে বাংলাবাজার পত্রিকায়। কিন্তু মহানগরীর নরকবাস আর অফিসাঙ্গনের দূষিত নিঃশ্বাস দিনে দিনে শেষ করে দিচ্ছিলো আমাকে। মুক্তির জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছিলাম আমি। একটা শান্ত-স্বাধীন-নিরাভরণ জীবনের বিভোর স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দিতে কত যে সাধনা করেছি! অবশেষে আজ থেকে প্রায় সোয়া দুই বছর আগে কালের কণ্ঠের যুগ্ম সম্পাদকের পদ পায়ে ঠেলে, রাজধানীর ‘রাজকীয়’ জীবন ত্যাগ করে, পাহাড়-টিলা-জঙ্গল আর চা বাগানের সবুজঘেরা স্নিগ্ধ-সুন্দর প্রকৃতির মাঝে গোটা পঁচিশেক নৃ গোষ্ঠীর বিচিত্র সংস্কৃতিসমৃদ্ধ শান্তিপ্রিয় মানুষের জেলা মৌলভীবাজারের আরো শান্ত জনপদ কমলগঞ্জে চলে আসা এই অধমেরও ডাক পড়লো উভয় পক্ষ থেকে।
এই সুযোগ কে ছাড়ে! একজন মহানের পাশে বসে ২০০ কিলোমিটার পথ যাওয়া আবার আসা, মাঝখানে আরো কত সময় একসঙ্গে থাকা; এতো কাছ থেকে এতো বড় গুণীজনকে জানতে পারার সৌভাগ্য সবসময় মেলে না। আমি চড়ে বসলাম সিরাজ ভাইকে বহন করা গাড়িতে। সঙ্গে চললেন কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. জুয়েল আহমেদ, কালের কণ্ঠর মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম ও কমলগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান।
দলবেঁধে গাড়িযাত্রার শুরুতে হাসি-আনন্দ-গল্পের পর অনিবার্যভাবে চলে আসে গান। মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসে সাইফুল গানের কথা তুলতেই মেয়র জুয়েল তাঁর মোবাইল ফোনের ব্লু-টুথে সংযোগ দিয়ে গাড়ির স্পিকারে বাজিয়ে দিলেন যুগের ক্রেজ ফোক গান। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, রাধারমন, ফকির শাহাবুদ্দিনে মন ভরিয়ে সাইফুল বললেন, ‘এবার সিরাজ ভাই বলেন, কী গান বাজাবো?’ সিরাজ ভাই চুপ। আমি প্রথম থেকেই সমস্ত মনোযোগ দিয়ে রেখেছি সিরাজ ভাইয়ের দিকে। একজন আহমদ সিরাজকে এতো কাছে থেকে পর্যবেক্ষণের এই সুযোগ এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। আমার চোখ-কান-নাক-মুখ-ভাব-অনুভব সব খাড়া। প্রথম থেকেই খেয়াল করছি, গাড়িতে ওঠার পর থেকে সিরাজ ভাই চুপচাপ। সাইফুল আবারো জানতে চাইলেন, ‘কী গান শুনবেন সিরাজ ভাই?’ সিরাজ ভাই যাথারীতি চুপ। পিছের সিট থেকে আমিও বললাম, সিরাজ ভাই, একেক সময়ে একেক রকমের গান শোনার মুড আসে। আপনার এখন কোন মুড, বলেন। আমরাও শুনি সেই গান। সিরাজ ভাই একটু মুচকি হাসি দিলেন শুধু, কিছুই বললেন না। সাইফুল ও মেয়র জুয়েল নিজেদের পছন্দমতো গান বাজাতে থাকলেন। শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে আমাদের মধ্যে যখন আলোচনা চলছে, আর কার কার গান শোনা যায়, তখন হঠাৎ মুখ খুললেন সিরাজ ভাই। বললেন, দ্বিজ দাসের গান বের করো।
ঢাকার পথে প্রায় অর্ধেক পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। সিরাজ ভাইয়ের মুখে প্রথম বুলি শুনলাম এবং চমকে গেলাম। দ্বিজ দাস! এই নামের কোনো শিল্পীর কথা তো জীবনেও শুনিনি? অথচ গান-সুর ও শিল্পীদের সম্পর্কে আমার ‘বিরাট জ্ঞান!’ পরিচিতমহলেও আমার ‘বিরাট সুনাম’! কিন্তু আমি জানি, পুরোটাই ফাঁকি! সঙ্গীতশাস্ত্রে আমি বিরাট মূর্খ। সঙ্গীতের ‘স’ও জানি না, বুঝি না। আসলে যেটা সত্যি, সেটা হলো- সঙ্গীতের বিরাট শ্রোতা আমি। উচ্চাঙ্গ থেকে ‘নিম্নাঙ্গ’- বাংলার প্রায় সব ধরণের গান শুনতে শুনতে, শুনতে শুনতে আমি একটা বিরাট ‘শুনে মুসলমান’। কোনো বাংলা গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজা ধরলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি বলে দিতে পারি- এটা অমুক গান আর অমুক শিল্পীর গাওয়া। এমনকি, এটাও বলে দিতে পারি যে, এইটা আদি গান আর এইটা রিমিক্স। যৌবনকালে যখন স্মৃতিশক্তি আরো টনটনা ছিল, তখন তো প্রায়ই এর ওর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান বের করে বাজি ধরে বসতাম, যেকোনো পাতা উল্টাও, অন্তত একটা গান হলেও আমার কমন পড়বে এবং সুরটা কী ধাঁচের, আমি গুনগুনিয়ে বলতে পারবো। প্রায় দিনই আমি বাজিতে জিততাম। আর সেই আমি কি না দ্বিজ দাস নামে কোনো শিল্পীর কথা আজও শুনিনি! ‘দ্বিজ দাস কী গান গায় সিরাজ ভাই?’- আমার প্রশ্ন শুনেও চুপচাপ সিরাজ ভাই। হয়তো মনে মনে বললেন, ‘শোন্ আগে মূর্খ!’
মেয়র জুয়েল আর সাইফুল দুজন মিলে বহু কসরতের পর বের করতে পারলেন। শুরু হলো দ্বিজ দাসের গান- ‘আমি আর তুমি কী/আগে কী, পাছে কী/আছে কী, যাবে কী/বলো না তাই বলো না/… কল্পনা যার মূল, আসলে তাই ভুল/শূন্য ভিন্ন অন্য, দেখি না দেখি না/… যদি বা রয়েছো, আমাতে আছো/ সর্ববিশ^ব্যাপী কি না/আমার মধ্যে তুমি, তোমার মধ্যে আমি/আমি বিনা তুমি কিছুই না কিছুই না/…।’
রুদ্ধশ্বাসে শুনতে থাকলাম দ্বিজ দাস। শুরু হলো পরের গান- ‘টান দিয়া ডাকিলে তারে উত্তর নাহি পাই/হাজার মন্দ বললেও সে বেজার খুশি নাই/ও সে কি এমন ধোঁকা/কার কী লাগে ঠেকা/থাকা না থাকা একই সমান…।’
আমি আবারো লজ্জাহত; আত্মধিক্কারে মাথানত। এমন বিষয় নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় গান বেঁধে, সুরেলা সুর দিয়ে গেয়ে বেড়ানো হয়েছে এই বাংলায়! আর আমি অধম সেসবের কোনো খবরই রাখি না! মনে মনে বললাম, ‘এই না হলে সিরাজ ভাই! রতনে রতন চেনে, তৌহিদে চেনে কচু!’ একজন আহমদ সিরাজের বিস্ময়-দুয়ার যেন খুলতে শুরু করলো আমার বোধের সামনে!
অস্থির, উত্তেজিত আমি বারবার দ্বিজ দাস সম্পর্কে জানার জন্য এটা সেটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি; কিন্তু পাত্তাই দিচ্ছেন না সিরাজ ভাই। এবার বললেন, দিলওয়ার বাজাও। সিলেটের আরেক প্রাণভ্রোমরা কবি দিলওয়ারের লেখা যে অনেক গানও আছে, তাও শোনা হয়নি কখনো। ‘মুর্শিদ আমি খুঁজবো না গো বন জঙ্গলে যাইয়া/আমার মাঝে আমার মুর্শিদ আছে যে পথ চাইয়া…’। এমন মধুর সুরেলা গান খুব কমই শুনেছি জীবনে।
গানের গাড়িটা সুরের ছন্দাবেগে ছুটে কখন যে পৌঁছে গেলো ঢাকায়, টের পাইনি। আমি নেমে গেলাম আমার খালার বাসায়। সিরাজ ভাইয়েরা চলে গেলেন তাঁদের জন্য বরাদ্দ বনানীর তিন তারকা হোটেলে।
সারা রাত অজানা অস্থিরতায় ঘুমাতে পারলাম না। সকালে উঠে কিছু জরুরি কাজ সেরে সন্ধায় গেলাম বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে। সিরাজ ভাইয়েরা আগেই ঢুকেছেন। সম্মাননাপ্রাপ্যদের সারিতে একটি আসনে চুপটি মেরে বসে আছেন সিরাজ ভাই। ওইভাবেই পুরো অনুষ্ঠান শেষ করে, একসঙ্গে ডিনার খেয়ে, সম্মাননা উপহারসামগ্রী গাড়িতে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরদিন সকালে আবার রওনা কমলগঞ্জের পথে। ভাবলাম, ক্লান্ত-শ্রান্ত সিরাজ ভাই; তাই ফেরার পথেও চুপচাপ। অনেক করে জানতে চাইলাম, কেমন লাগলো অনুষ্ঠান; কী আপনার অনুভূতি? সিরাজ ভাই চুপ। একবার শুধু মুখ ফুটে বললেন, ‘অনেক বড় আয়োজন।’ বাকি সব প্রশ্নের জবাব যেন মনের মধ্যে রেখে দিলেন।
আবার বেজে উঠলো গান, তবে ততক্ষণে গা এলিয়ে দিয়েছেন সবাই। কিন্তু সিরাজ ভাই রয়েছেন আগের মতোই শিরদাঁড়া সটান বসা। তিনি এবার সামনের সিটে। মাঝের সিটের ডান কোনায় আমি। চোখ আমার এবারও সিরাজ ভাইয়ের দিকে। দুপুরের ভাতঘুমের আমেজে অন্যদের চোখ ঢুলুঢুলু। সিরাজ ভাই তাকিয়ে। চোখের দৃষ্টি বাইরে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে! কিসের ধ্যানে যেন মগ্ন সারাক্ষণ। আসার সময়ও দেখেছি; যাবার সময়ও তাই। মুণি-ঋষিদের মতোই ধরাধমে থেকেও যেন নেই। এমনিতেই কি আর এতো সব কাজ করে চলেছেন সিরাজ ভাই! কী করেননি তিনি! সিলেটের যুগভেরী, সিলেট সমাচার, সিলেট কণ্ঠ, ঢাকার একতা, সংবাদে নিরলস সাংবাদিকতা; দৈনিক প্রথম আলো, সমকাল, এককালের বাংলাবাজার পত্রিকায় নিয়মিত কলাম-ফিচার-নিবন্ধসহ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক, লিটল ম্যাগসহ সব ধরনের পত্রপত্রিকায় নিরন্তর লেখালেখি; শিক্ষকতা, পাঠাগার ও নানা পদের সভা-সংগঠন, শিশু-কিশোর সংগঠন গড়ে, উদীচী-খেলাঘর-মহিলা সমিতি-মানবাধিকার বাবাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দান; স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীগুলোর ১২টি ভাষার সমন্বিত ভাষা উৎসব উদযাপন; দলিত-অবহেলিত জনগোষ্ঠী, যেমন- চা শ্রমিক, কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, শব্দকর, মৌচাষী থেকে শুরু করে কৃষক-শ্রমিকের কল্যাণে বহুমুখী উদ্যোগ-আয়োজনের পাশাপাশি অনেকগুলো অনুসন্ধানী ও গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন আহমদ সিরাজ।
তাঁর এসব কাজের কথা জানতে পেরেছি ঢাকায় আসার আগে সাংবাদিক সাইফুল ও মোস্তাফিজের পাঠানো আহমদ সিরাজের অতি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন সম্পাদনা করতে গিয়ে। গাড়িতে বসে সেসব স্মরণ করতে করতে এসে পড়লাম লাউয়াছড়া জাতীয় জঙ্গলের পথে। তারপর পাকড়াও সেই অধীর অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেলবাহিনীর হাতে। এই বাহিনীর নেতা আরেক সংগ্রামী সাংবাদিক সংগ্রাম সিংহর পিছে পিছে সবাই গিয়ে উঠলাম পৌরভবনে। বাংবাদিক সাইফুল আগেই নেমে গেছেন শ্রীমঙ্গলে। মেয়র জুয়েল পুরো রাস্তায় তাড়া দিচ্ছিলেন দ্রুত যাওয়ার জন্য। তাঁকে আজ অফিস করতেই হবে। কিন্তু তাঁর অফিসকক্ষ ভরে গেলো উচ্ছ্বাস-আবেগে উদ্বেলিত সাংবাদিকদলে। ৮টা মোটরসাইকেলে চেপে ১৫-১৬ জন গিয়েছিলেন বনের পথে ব্যারিকেড দিয়ে সিরাজ ভাইকে ছিনতাই করতে। অপেক্ষা করে করে জরুরি কাজে ফিরে গেছেন ৪-৫ জন। মেয়রের ঘরভরা এখন ১২ জন স্থানীয় যুবা সাংবাদিক- বিশ্বজিৎ রায়, শাব্বীর এলাহী, সাজিদুর রহমান সাজু, আহমেদুজ্জামান আলম, আব্দুর রাজ্জাক রাজা, নির্মল এস পলাশ, সাদিকুর রহমান সামু, সালাহউদ্দিন শুভ, রুহুল ইসলাম হৃদয়, আর কে সৌমিন, মুমিন ইসলাম। চেয়ারে বসেও যেন আবেগ-উত্তাপে ফুটছেন সবাই। মুহূর্তের মাঝে তাদের মুখোমুখি একটা মেঝেমঞ্চ বানিয়ে জোর করে বসিয়ে দিলেন আমাদের চারজনকে। সিরাজ ভাইকে মধ্যমণি রেখে দুই পাশে মেয়র, সংগ্রামদা আর আমি। দ্রুত মিষ্টি মুখামুখি সেরে উপস্থাপনা শুরু করলেন মোস্তাফিজ- প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা। আমরা আজ গর্বিত; আনন্দিত, সফল…। আমাদের প্রাণপ্রিয় সিরাজ ভাই আজ…। সংক্ষিপ্ত ভূমিকা করে দ্রুত ফ্লোর ছেড়ে দিলেন তিনি উদগ্রীব সাংবাদিকদলে। একে একে প্রায় সবাই শ্রদ্ধাকাঁপা, ভালোবাসাভেজা বিনয়াবনত কণ্ঠে মনের মজুদ কথামালা গড়িয়ে দিলেন সিরাজ ভাইয়ের চরণে। একজন বললেন, ‘ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট, চেক, উত্তরীয়র সম্মাননার চাইতে বড় কথা- এতোদিন পর আমরা পেলাম আমাদের সিরাজ ভাইয়ের যোগ্য স্বীকৃতি।’
আরেকজন বললেন সেই শ্লোগান-উল্টানো কথাটি- ‘আমরা সিরাজ ভাইয়ের আদর্শ ধারণ করি। কিন্তু তাঁর আদর্শ যে কী, সেটা জানি না। আমরা শুধু দেখছি, পুরো কমলগঞ্জ আস্তে আস্তে সিরাজ ভাইয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। আর জাতীয় পর্যায় থেকে এই সম্মাননা ও স্বীকৃতিপ্রাপ্তির মাধ্যমে গোটা মৌলভীবাজার জেলাও আজ সিরাজ ভাইমুখী। এভাবে গোটা সিলেট বিভাগ, এমনকি গোটা বিশ্বই যদি সিরাজ ভাইয়ের মধ্যে এসে পড়ে, তাহলেই পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠবে…।
ত্বরিত সংবর্ধনাটা শেষ হতেই তড়িৎ গতিতে ছুটে এলেন আরেক সিরাজ-পাগল সাংবাদিক মোনায়েম খান। আরো এলেন সাবেক প্রধানশিক্ষক-সাংবাদিক বীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, এবং আসতে না পেরে আফসোস করছেন অনেকে। আরো জানা গেল, সকালে আর দুপুরে দুই-দুইটা অনুষ্ঠান হয়ে গেছে কমলগঞ্জে। একটা হলো- কমলকুঁড়ি পত্রিকার এক যুগপূর্তি আর তামাকবিরোধী দিবসের অনুষ্ঠান। দুটো অনুষ্ঠানই নাকি নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাপিয়ে হয়ে উঠেছিল আহমদ সিরাজময়।
বুঝতে আর বাকি রইলো না, এখানকার সাংবাদিকতা-ঘরানার সব কাজে নিয়োজিত সবার অস্তিত্বজুড়ে রয়েছেন আহমদ সিরাজ। মেয়র জুয়েল আরেক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘শুধু সাংবাদিক-লেখক-বুদ্ধিজীবী না, আজ আপনে নানাকে (আহমদ সিরাজকে) বাজারের ভেতর দিয়ে হাঁটায়ে নিয়ে যান, দেখেন কী হয়! তাঁরে আর আস্ত নিতে পারবেন না। মানুষজন ঝাঁপায়ে পড়বে শুভেচ্ছা জানাতে। তাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দেবে।’
সবথেকে বেশি উদ্বেলিত সংগ্রাম সিংহ। কমলগঞ্জের এই কৃতী সাংবাদিক কাজ করেন দৈনিক যুগান্তরের সিলেট ব্যুরো প্রধানের, থাকেনও সিলেট শহরে। সিরাজ ভাইয়ের এই অর্জনের খবর শুনে অসুস্থ শরীরেই ছুটে এসেছেন আপন মাটিতে। প্রথম থেকেই আবেগোল্লাসে ছোটাছুটি করছেন সিংহশাবকের মতোই। শিশুসুলভ মনের প্রকাশ তাঁর অবয়বজুড়ে। কতো কী যে বলে চললেন আহমদ সিরাজের লেখা ও কাজ নিয়ে! সবশেষে একটা দাবি তুললেন মেয়রের দিকে তাকিয়ে- ‘সিরাজ ভাইয়ের কোনো লেখার একটা হরফও আর যেন অমুদ্রিত না থাকে, সেই দায়িত্ব নিতে হবে আপনাকে।’ মেয়রও কবুল শুধু না, কবুল প্লাস করে বললেন, আহমদ সিরাজের সব কথা, সব দাবি মেনে চলবো আমি। তিনি আমাদেও অহংকার।’
অবশেষে সবাই মিলে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাকে। কিছু বলতেই হবে। আমি নারাজ; ওরা নাছোড়। দেশের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন লেখাপাগল-কর্মচঞ্চল কল্যাণসাধক অগ্রজের প্রতি অনুজদের এমন অকৃত্রিম, স্বতঃস্ফ‚র্ত, হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসার নজিরবিহীন নজির দেখে আমার বাকরুদ্ধ আবস্থা। কিছুই বলতে পারবো না; আমার মনের ভাব অন্যভাবে প্রকাশ করবো জানিয়ে শুধু বললাম, ‘আমি যে সব ছেড়েছুড়ে কমলগঞ্জে আশ্রয় খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সিরাজ ভাইকে ঘিরে আজ যা যা ঘটতে দেখলাম, শুনলাম, অনুভব করলাম, তাতে করে আজ আমি শতভাগ নিশ্চিত হলাম যে, আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সঠিক বটবৃক্ষের ছায়ায় চলে এসেছি। আর চিন্তা নাই আমার।’
এবার সিরাজ ভাইয়ের বলার পালা। তিনি দাঁড়ালেন। প্রথমেই বললেন, ‘আমাকে নিয়ে তোমরা যা করছো, এগুলো অযথা, বেশি বেশি। এতো বড় কিছু করিনি আমি। যা করেছি নিজের আনন্দে করেছি। এভাবে কাজ করে গেলে এখানে যারা উপস্থিত, তাদের সবাই এ রকম সফল হতে পারে। যে কেউ সেই যোগ্যতা রাখে। দরকার শুধু কাজ আর সাধনা।’
সিরাজ ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। আমিও যাবো। সবাই বললেন, না না, আপনে বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। আমরা যাচ্ছি। আমি নাছোড়বান্দা- না, সিরাজ ভাইয়ের বাসা পর্যন্ত আজ যাবোই। গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছাড়লো। কিন্তু আমার বাসার সামনে গিয়ে গাড়ি আর ‘চলে না, চলে না রে!’ সিরাজ ভাইও আমাকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কেন যেন আমাকে তাঁর বাসা পর্যন্ত নিলেনই না।
আমি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম রাস্তায়। সিরাজ ভাইকে বহন করা গাড়িটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর আমি মাথা নিচু কওে ঘরে ঢুকলাম। বাচ্চারা ছটে এলো। ‘বাবা, তুমি চলে আসছো ঢাকা থেকে!’ ‘হ্যাঁ বাবা। তোমার জন্য কত কী আনছি, দেখো!’ ব্যাগ থেকে চকোলেট, বিস্কুট, খেলনাপাতি বের করে করে দিলাম। ওরা আনন্দে মাতোয়ারা হলো। আমি ধীর পায়ে গোসলে গেলাম। ভাত খেতে বসলাম। বাচ্চাদের আনন্দে শরিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে থাকলো মনটা। অনেকক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে বেজে চললো রবীন্দ্রগানের সেই সুরটা- ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা…।’
দুই-এক দিনের মধ্যে সেইখানে যাবোই এবার, ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু সাংবাদিক মোস্তাফিজ এসে জানালেন, সিরাজ ভাই মহাবিরক্ত।
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘ওই যে, সারা দিন-রাত লোকজন আসছে; শ্রদ্ধা-সম্মান-শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে প্রচুর!’
আমি আবার গেলাম থেমে। মনের খায়েশটা আর প্রকাশ করলাম না। অবাক বিস্ময়ে শুধু ভাবতে থাকলাম- একজন আহমদ সিরাজের এতোটুকু দেহের মাঝে এতো বড় একটা মন; তার মাঝে এতো বিচিত্র গুণ বাসা বেঁধে থাকে কেমন করে!
- তৌহিদুর রহমান। লেখক ও সাংবাদিক।