সিলেটের বিয়ানীবাজারে ট্রাকভর্তি চিনি ছিনতাই হওয়ার চারদিন পর চার ভাগের মধ্যে একভাগেরও কম চিনি মঙ্গলবার (১১ জুন) বিকালে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে নাটকীয় হলেও সত্য, ঘটনার চারদিন পর চিনির মালিক চিনি উদ্ধারের দিনই দুপুরবেলা থানায় লিখিত অভিযোগ করেন এবং এরপর পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে ট্রাকভর্তি চোরাই চিনির মধ্যে মাত্র ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। তবে কোন আসামীকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জানা গেছে, গত শনিবার (৮ জুন) ভোর ৬টার দিকে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের বিয়ানীবাজার অংশের চারখাই লালপুর এলাকায় সরকারি নিলাম থেকে কেনা বিয়ানীবাজারের বদরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর ২৪ লাখ টাকার ৪’শ বস্তা চিনি ও চিনি বহনকারী একটি ট্রাক অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। এরপর থেকে বিষয়টি হয়ে উঠে টক অব দ্যা টপিকে, ঝড় উঠে সমগ্র উপজেলাজুড়ে।
চিনি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় শুরু হলেও ঘটনার চারদিন পর্যন্ত ৪’শ বস্তার চিনির বৈধ মালিক দাবি করা ব্যবসায়ী বদরুল ইসলাম থানা পুলিশের কাছে করেননি লিখিত অভিযোগ। তবে পুলিশের দাবি ছিল, ওই ব্যবসায়ীর মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে হঠাৎ করেই মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে প্রেস ব্রিফিং করে থানা পুলিশ। ব্রিফিংকালে উপস্থিত ছিলেন জকিগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াহইয়া আল মামুন ও বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ দেব দুলাল ধর।
এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াহইয়া আল মামুন জানান, অস্ত্রের মুখে চিনি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মঙ্গলবার বিয়ানীবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন চিনির মালিক ব্যবসায়ী বদরুল ইসলাম। মামলার এজাহারে ঘটনার সাথে জড়িত ১১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ৭-৮ জনকে আসামী করা হয়েছে। এরপরই পুলিশ একাধিক টিমে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। অবশেষে মঙ্গলবার দুপুরে পৌরসভার সুপাতলার আব্দুর রহমানের বসতবাড়ির পেছনে চারা বাগান থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৮০ বস্তা চিনি এবং একই সাথে চিনি বহনকারি একটি পিকআপ ভ্যান নিদনপুর এলাকার তাজ উদ্দিন মিস্ত্রির বাড়ি থেকে উদ্ধার করে।
উদ্ধার কাজ চলাকালে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযানের গোপনীয়তার স্বার্থে আসামীদের নাম আপাতত উল্লেখ করা হচ্ছে না। তবে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও অবশিষ্ট ৩২০ বস্তা চিনি উদ্ধারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াহইয়া আল মামুন বলেন, চিনির মালিক দাবি করা ব্যবসায়ী মালিকানার বৈধতা দেখাতে পারেননি। তিনি সেটা আদালতে দেখাবেন বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিয়ানীবাজারে চিনি লুটের পর থেকেই কানাঘুঁষা চলছে স্থানীয় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে। ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে ছিনতাই চক্রের মুখোশ, বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। গুঞ্জন রটাচ্ছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিয়ে।
চিনির মালিক চারখাই বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমিন ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী বদরুল ইসলাম। তিনি জানান, নিলামে ১ হাজার ৪’শ ৭৭ বস্তা চিনি ক্রয় করেন। শনিবার দুপুরে ওই চিনি অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। ১৫-১৬ জনের একটি চক্র একটি প্রাইভেটকার, চারটি মোটরসাইকেল এবং একটি পিকআপ নিয়ে চিনি বোঝাই ট্রাকের গতিরোধ করে। এ সময় তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ট্রাকচালককে জিম্মি করে বিয়ানীবাজার পৌরশহরে নিয়ে এসে পৃথক দুটি গ্রামে চিনি ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। চিনি লুটের ঘটনায় উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের শীর্ষ তিন নেতা নেতৃত্ব দেন বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ী বদরুল ইসলাম। তবে তিনি তাদের নাম-পরিচয় জানাননি।
এদিকে, বাদীর দায়ের করা মামলায় কারা রয়েছেন কিংবা আদৌ স্থানীয় ছাত্রলীগের পদবীধারী কোন নেতাকর্মী জড়িত কিনা জানতে চাইলে বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ দেবদুলাল ধর বলেন, মামলার এজাহার ১১ জন আসামীর নাম রয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৭-৮ জন আসামী আছেন। তবে আসামীদের নাম পরে প্রকাশ করা হবে, আপাতত তদন্তের স্বার্থে গোপন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিয়ানীবাজার পৌরশহর ছাড়াও উপজেলার চারখাই, দুবাগ ও বারইগ্রাম বাজারে অবৈধ চিনির চোরাকারবার ও বাজারজাত চলছে দেদারছে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনিক অভিযান পরিচালিত হলেও চোরাচালানের সাথে জড়িত মূলহোতারা সবসময় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
তবে পুলিশ প্রশাসন বলছে, বিয়ানীবাজারে যেসব রুট দিয়ে ভারতীয় অবৈধ চিনি প্রবেশ করে এবং যেসব ব্যবসায়ী ও আড়তদার অবৈধ চিনির চোরাচালান ও মজুদের সাথে জড়িত পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে, সংশ্লিষ্টতা পেলেই আইনী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবে।