‘আমাদের সংসার চালানোর মতো কিছুই নেই। আজ ১৬ দিন হয়ে গেছে, আমরা কষ্টে আছি। যখন বেতন পেতাম, তখনই আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হতো। আর এখন তো কাজ নেই, বেতনও নেই। এখন আমার ঘরে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। চাল নেই, তেল নেই, ডাল নেই, আলু নেই। এমনকি আমরা বাচ্চাদেরও কিছু খেতে দিতে পারছি না। বাচ্চারা অনেক কষ্টে আছে।’
বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের এক নারী শ্রমিক। সাত ছেলে-মেয়ে আর অসুস্থ বাবার মুখে একমাত্র অন্নদাতা স্বামী হারানো চা শ্রমিক তিনি। মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে তার টানাটানির সংসার একেবারেই চলছিল না। তাই সবার সাথে নেমেছেন মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে।
কর্মবিরতির টানা ১৬ দিন থেকে মজুরি নেই। তাই দিনকে দিন ভারি হচ্ছে তাদের অসহায়ত্বের পাল্লা। ঘরে কোনো খাবার নেই। সকালে নিজের অসুস্থ বাবাকে উপোস রেখে এসেছেন বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন এই শ্রমিক।
এই কান্না তাঁর একার নয়। অন্য চা শ্রমিকদের অবস্থাও অনেকটা তাঁরই মতো। মজুরি না বাড়লে সংসার চলছে না, আবার মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চলমান ধর্মঘটেও তাদের রোজগার বন্ধ। এ যেন উভয় সংকট!
চোখ মুছে এই শ্রমিক বলেন, গতকাল রাতে চিড়া খেয়েছি, বাচ্চাদেরও চিড়া খাইয়েছি। কিন্তু এতে তো বাচ্চাদের পেট ভরে না। ওরা ভাত খেতে চায়। ওদেরকে বলতেও পারছি না যে আমাদের ঘরে চাল নেই। কে কাকে চাল দেবে? সবার ঘরে তো একই সমস্যা। বাগানে কাউকে কিছু দিয়ে সাহায্য করবে এমন মানুষ নেই। আমরা এভাবেই না খেয়ে চলছি। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না আমরা কিভাবে বাঁচবো।
এই সংকটে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই নারী চা শ্রমিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের ৩০০ টাকা মজুরি দিয়ে দেন, তাহলে আমাদের এই কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমরা তো উনার কাছে হাজার টাকা চাইছি না, চাইছি মাত্র ৩০০ টাকা। ৩০০ টাকা দিয়ে দিলে উনার কী হবে? উনার কাছে তো ৩০০ টাকা কিছুই না। কিন্তু ৩০০ টাকা আমাদের কাছে অনেক টাকা। ৩০০ টাকা মজুরি পেলে আমরা কোনোমতে চলতে পারবো, আমাদের বাচ্চাদের খাওয়াতে পারবো।
এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরার জীবন চান না জানিয়ে তিনি বলেন, যদি দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি না দেওয়া হয়, তাহলে তা আমাদের জানিয়ে দেন। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তায় উঠে বসে থাকবো। আমাদের যেন সেখানে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমরা এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না। বাচ্চারা আমাদের চোখের সামনে না খেয়ে মরবে, এটি আমরা কিছুতেই মানতে পারবো না।
প্রসঙ্গত, দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে গত ৯ আগস্ট থেকে চারদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি ও পরে ১৩ আগস্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন চা শ্রমিকরা। প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও সেটা মানেননি না সাধারণ শ্রমিকরা।