বহুল প্রত্যাশিত মাল্টি লেন আন্ডারওয়াটার এক্সপ্রেসওয়ে টানেল যুগে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হচ্ছে। দেশবাসীর স্বপ্নপূরণের ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আজ।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশ ভেদ করে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম টানেল বা সুড়ঙ্গ পথ। শুধু দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও এটি প্রথম। ভারতে স্থল টানেল থাকলেও নদীর তলদেশে কোনো টানেল এখন পর্যন্ত নেই। বঙ্গবন্ধু টানেল শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলেই নয়, পুরো দেশের অর্থনীতিতেই যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে আজ বেলা ১১টায় একটি ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করবেন এবং টানেল পার হওয়ার পর আনোয়ারা নদীর দক্ষিণ তীরে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরেকটি নতুন মাইলফলক টানেল যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। নদীর তলদেশ দিয়ে রোমাঞ্চকর যাত্রার স্বাদ নিতে পারবে জনসাধারণ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পর নতুন সংযোজিত হলো বঙ্গবন্ধু টানেল।
টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আজ দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) মাঠে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধন ঘিরে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে বর্ণিল উত্সবের আয়োজন করা হয়েছে। নানা ধরনের ব্যানার-ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, তোরণ স্থাপন করা হয়েছে টানেলের দুই প্রান্তেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে পুরো নগরীকে পরিপাটি করে তোলা হয়েছে; সাজানো হয়েছে ভিন্ন আমেজে। এদিন প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী দিনের খাম এবং প্রথম নদীর তলদেশে সড়ক টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে একটি বিশেষ সিলমোহরও অবমুক্ত করবেন।
টানেল উদ্বোধনকে ঘিরে স্মরণকালের বড় জনসভা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। বিভাগের ১১ জেলা থেকেই আসবেন নেতাকর্মী। জনসভায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম করার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। জনসভার স্থলে নৌকার আদলে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। টানেলসহ মোট ২০ প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরমধ্যে ১৭টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করে উদ্বোধন করবেন। তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি।
তিন মিনিটে কর্ণফুলী পার
স্বপ্নের টানেল চালু হওয়ায় এবার কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে উঠবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম টানেল বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে। টানেলটি হাজারো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার। নদীর তলদেশ দিয়ে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট সময় লাগবে।
টানেলের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আধুনিক স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারতের পণ্য পরিবহনে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। শিল্পায়নের কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। কমবে পণ্য পরিবহন ব্যয়; সাশ্রয় হবে সময়।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখ। টানেলটি দেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০ দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়াতে সহায়তা করবে। প্রথম পাঁচ বছর মেইনটেন্যান্স ও অপারেশন করবে চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি। উদ্বোধনের পরদিন সকাল থেকে টানেল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে আপাতত টানেলের ভেতর দিয়ে রিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেলসহ কোনো টু হুইলার, থ্রি-হুইলার যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। কেউ হাঁটাহাঁটিও করতে পারবেন না ১০০ বছর লাইফটাইমের এই টানেলে।
যেভাবে ঢুকবে যানবাহন
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পণ্যবাহী গাড়িগুলো গোলচত্বর দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই চলে যাবে বাঁ পাশে। সেখানে রয়েছে স্ক্যানার। স্ক্যানিং শেষে গাড়িগুলো চলে আসবে ওজন স্কেল এলাকায়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ করে তারপর সোজা মূল টানেলে ঢুকে যাবে এসব গাড়ি। তবে কার, মাইক্রোবাস, বাসসহ এ ধরনের পরিবহনের জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যাতে আলো নিয়ে চালক ও যাত্রীদের কোনো ধরনের অস্বস্তি না হয়, সেভাবে আলোকায়ন করা হয়েছে। আবার টানেলের ভেতরে কোনো কারণে দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে যাত্রী ও চালকদের তাত্ক্ষণিকভাবে উদ্ধারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেখানে। টানেলের দুটি সুড়ঙ্গ বা টিউবের কোনোটিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্য সুড়ঙ্গে নিয়ে আসা হবে। এজন্য দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে যাতায়াতের জন্য রয়েছে তিনটি ক্রস প্যাসেজ বা সংযোগ পথ। টানেলে জরুরিভাবে বের হয়ে আসার নির্দেশনামূলক সাইন পোস্ট রয়েছে কিছু দূর পরপর। টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা নদীর তলদেশ থেকে ৩১ মিটার। অর্থাত্ প্রায় ৯ তলা ভবনের সমান উচ্চতা। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে টোল প্লাজা। সেখানে যাতে গাড়ির জট না হয়, সে জন্য অন্তত ২০টি টোল বক্স রয়েছে। টানেলের টোল প্লাজা পার হয়ে সংযোগ সড়ক দিয়ে গাড়ি চলে যাবে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের চাতরী এলাকায়।
প্রসঙ্গত, দুই দফা ব্যয় সংশোধন করে এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ৬০ শতাংশ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। টানেলের পুরো রুটের দৈর্ঘ্য হলো ৯.৩৯ কিলোমিটার (৫.৮৩ মাইল), সুড়ঙ্গটির দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার (২.০৬ মাইল) ও এর ব্যাস ১০.৮০ মিটার (৩৫.৪ ফুট)। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে নির্বাচনি জনসভায় টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবং ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি টানেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ-চীন সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
সিলেট ভয়েস/এএইচএম