খুলনায় এক সার্জনের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে একসময়। ঢাকায় এসে নিজেই বনে যায় সার্জন। রাজধানীর মালীবাগের মাহি হাসান টাওয়ারের চতুর্থ তলায় খুলে বসে লেজার বিউটি পার্লার, যেখানে পুরুষদের তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করা হয়। একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এমন ব্যবসা করে আসছিল হাদিউজ্জামান রহমান নামে ওই ব্যক্তি। মূলত তার নেতৃত্বে একটি চক্র মানুষের লিঙ্গ পরিবর্তন করে থাকে, আর পরিবর্তিত লিঙ্গের এসব মানুষ বিভিন্ন জায়গায় হিজড়া সেজে চাঁদাবাজি ও ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ায়।
গত পাঁচ বছর ধরেই চক্রটি খুলনা ও ঢাকায় এই অপরাধ করে আসছিল। অবশেষে শুক্রবার (২৯ জুলাই) চক্রটির সদস্যদের গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
শনিবার (৩০ জুলাই) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, চক্রের প্রধান হাদিউজ্জামান রহমান। তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তারও তার সহযোগী। তাদের অপকর্ম নিশ্চিত হয়ে এই দম্পতির দুই সহযোগীসহ তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
কথিত সার্জন হাদিউজ্জামান গ্রেফতারের পর পুলিশকে জানিয়েছেন, সে খুলনায় এক সার্জনের সহযোগী ছিল। সেখানে পুরুষদের তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরিত করা হতো। সেখানে কাজ শিখে ঢাকায় চলে আসে। এরপর ঢাকায় এসে পার্লারের আড়ালে তিনি নিজেই সার্জন সেজে শুরু করে এই ব্যবসা। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া এই চক্রের আর কোনও বৈধ কাগজপত্র নেই। এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও ওষুধ সব চীন থেকে নিয়ে এসেছে চক্রটি।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাই নিয়ে আসে পুরুষদের
দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা তৃতীয় লিঙ্গে গুরু মায়েদের সঙ্গে অনেক পুরুষের সখ্যতা রয়েছে। এই সখ্যতা গড়ে ওঠার পর ওই সব পুরুষদের নিজেদের দলে রাখতে অফার দেন গুরু মা। এজন্য তাদের সার্জারি বা অপারেশন করতে বলেন। এ পর্যায়ে তারা হাদিউজ্জামানের ঠিকানা দেয়। মালিবাগের এই পার্লারে আসার পর পুরুষদের শরীরে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। এরপর তাকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং এক পর্যায়ের অপারেশন করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হাদিউজ্জামান বলেছে, ‘সার্জারির আগে হরমোন প্রয়োগ করে তাদের নারীসুলভ শরীর করা হয়। এরপর সার্জারি করা হয়।’ এসব সার্জারি সে নিজেই করে বলেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সংগঠনের নেতারা যা বলছেন
নিজেদের দিকে আসা অভিযোগ অস্বীকার করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সংগঠনের নেতারা বলছেন, ‘পুরুষরা স্বেচ্ছায় তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর হয়।’ অবশ্য এর পেছনে ‘বাণিজ্য’ রয়েছে বলেও জানান তারা। হিজড়া কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদক বহন, মাদক পাচার, মাদক বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির কারণে একটি চক্র স্বেচ্ছায় হিজড়া সাজে। বিভিন্ন বাণিজ্যের জন্য তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সাজে।’
রূপান্তরের ফি ১ লাখ টাকা
পুরুষ থেকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করতে প্রতি জনের কাছ থেকে ১ লাখ করে টাকা করে নেওয়া হতো বলে জানিয়েছে পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘প্রতিটি সার্জারির আগে হাদিউজ্জামান ১ লাখ করে টাকা নিতো। তার কোনও চিকিৎসা সনদ নেই, নেই কোনও কাগজপত্র। তারপরও সে এসব সার্জারি করতো। সে নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে অন্তত একশ পুরুষকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরিত করেছে।’
কৃত্রিম স্তন প্রতিস্থাপন ও ঠোঁটের আকার পরিবর্তনও করতো তারা
হাদিউজ্জামান তার পার্লারে পুরুষদের তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের পর তাদের কৃত্রিম স্তন প্রতিস্থাপনের কাজও করতো। এছাড়াও গায়ের রঙ ফর্সা ও ঠোঁটের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সার্জারি করতো সে। যার কোনও বৈধতা তাদের ছিল না।
ডিবি রমনা বিভাগ এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। পার্লারটি থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও ওষুধ উদ্ধার করেছে তারা।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা রিমান্ডে
মো. হাদিউজ্জামান চিকিৎসক পরিচয় দেওয়া একজন প্রতারক। তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তার তার সহযোগী। এছাড়াও হাদির সহকারী নুর ইসলাম এবং সোনিয়ার সহযোগী জনি আহমেদকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছে।
খোঁজা হচ্ছে অভিযুক্ত গুরু মায়েদের
এই চক্রের সঙ্গে জড়িত তৃতীয় লিঙ্গের যেসব ‘গুরু মা’ জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডিবি। রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক জানান, বর্তমানে আসামিরা দুই দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরসঙ্গে আর কারা জড়িত তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। যারাই জড়িত থাকুক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন