আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১৬ মাস। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী বিএনপি ও তার মিত্ররা মুখোমুখি।
বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে তারা আগামী নির্বাচনে যাবে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ। তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলে দিয়েছেন নির্বাচন করতে হলে সংবিধান মেনে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনড় অবস্থানের কারণে রাজনীতি সচেতন মহলেও চলছে তুমুল বিতর্ক।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভোট করতে এগুচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী যে সরকার দেশ পরিচালনায় থাকবে সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময় বিভিন্ন দল বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলেও সংবিধানের পথেই হাঁটতে চায় ইসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে নয়, কমিশন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে। যে সরকারই থাকুক আমরা তাদের কাছে যে সাহায্য চাইবো সেটি দিতে হবে।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, সরকারের অধীনে নয়, সরকার শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে।’
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, জাতীয় সরকারের কথা আমরা বলিনি। আমরা বলেছি নির্দলীয় সরকার। জাতীয় সরকার নিয়ে আমরা আন্দোলনটা করতে চাই না। আমাদের আন্দোলন হচ্ছে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ অবস্থান তৈরি করে নির্বাচন করা।’
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বলছে, আনুপাতিক হারে বিজয়ী ঘোষণা করা হোক। এজন্য দলটির মহাসচিব নির্বাচন কমিশনে একটি প্রস্তাবও দিয়েছেন।
আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। এই পদ্ধতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি ভালো মানুষও হোন, তিনি মন থেকেও যদি চান তবুও তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন না। তাকে তো সরকারের হেল্প নিতে হবে। সেই হেল্প করার মতো মানসিকতা কোনো সরকারেরই নেই। কারণ, যখন সরকার মনে করবে হেরে যাবে তখন নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে সাহায্য করবে বলে আমরা মনে করি না। তাই বলছি আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচন করলে ফেয়ার করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, দল হিসেবে জাতীয় পার্টি কখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসী না। চুন্নু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে বাতিল হয়েছে, সেই ব্যবস্থা তারা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে বলে মনে করেন না রাজনীতিবিদরা। তাছাড়া সংবিধান সংশোধন করতে হলেও সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। যেহেতু বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, তাই তাদের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃবহালের সম্ভবনা ক্ষীণ।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি করেছে তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য সমাধান নেই। কারণ প্রথমে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছিলেন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি বলেছিলেন, ‘একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।’
১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ২৬ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে পাস করে বিএনপি। এরপর যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। পরাজয়ের পর বিএনপি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল। পাঁচ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখনও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিল। তাই কোনো দলই এই সরকার ব্যবস্থার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। সেই থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।
এরপর গত দুটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই হয়। সেই দুটি নির্বাচনের একটিতে ২০১৪ সালে বিএনপি অংশ নেয়নি। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র ছয়টি আসনে জয়ী হয়। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যমান রেখে নির্বাচন করার পদ্ধতির সমালোচনা করে আসছে বিএনপি। তারা নির্বাচনকালীন সরকারের পরিবর্তন চায়। সেই দাবিতে দলটি আন্দোলনেরও হুমকি দিচ্ছে এবং নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
সূত্র : ঢাকাপ্রকাশ