পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে বালু ও পলি এসে জমে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলা এলাকার সোমেশ্বরী ও গোমাই নাব্যতা হারিয়েছে। এখানে-ওখানে জেগেছে চর। সেসব চর দিয়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে মানুষ। তবে যুগ যুগ ধরে পণ্য পরিবহনে নদীপথের ওপর ভরসা করে আসা মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে; কারণ মধ্যনগরের সঙ্গে জেলা শহরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। পণ্য পরিবহনের ভোগান্তিতে বড় ধরনের লোকসান গুনছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে ধান ও অন্যান্য পণ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমেশ্বরী নদী নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থেকে মধ্যনগর উপজেলা এলাকায় এসেছে। দুর্গাপর থেকে একটি শাখা বারহাট্টা উপজেলার ঠাকুরাকোনা হয়ে আটপাড়া উপজেলার দিকে চলে গেছে। বারহাট্টা উপজেলার ঠাকুরাকোনার তাইত্তর নামক স্থান থেকে একটি শাখা কংস নাম ধারণ করে যাত্রাবাড়ী থেকে মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা হয়ে সুখাইড় রাজাপুরের পাশ দিয়ে গাগলাজোড় বাজারের কাছে ধনু নদীতে সংযুক্ত হয়েছে। আর একটি শাখা নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা বাজারের পাশ দিয়ে গলহা, নিয়ামতপুর, কেশবপুর ও উবধাখালী নাম ধারণ করে গোরাডুবা হাওরের মাঝ সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে মধ্যনগর বাজারের পাশে গোমাই নদীতে সংযুক্ত হয়েছে। গোমাই নদী বারহাট্টা উপজেলার যাত্রাবাড়ী বাজারের কাছে কংস নদ থেকে একটি শাখা নদী মধ্যনগরে উবধাখালীতে যুক্ত হয়েছে। উবধাখালী নদী মধ্যনগর থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে কাইতকান্দার পাশে মূল সোমেশ্বরী নদীতে যুক্ত হয়ে পূর্বদিকে দুগনই আবিদনগরের পাশ ঘেঁষে তেলিগাঁও সরস্বতীপুর হয়ে শানবাড়িতে উত্তর দিক থেকে আসা পাটলাই নদীর প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরে এই নদী গোলকপুরের দক্ষিণে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ আসা সুরমার প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দক্ষিণে ধনু নদীতে পড়েছে। এই ধনু নদী সুনামগঞ্জের জেলার মূল প্রবাহ মেঘনাতে মিলিত হয়েছে। আর এই সোমেশ্বরী ও গোমাই নদী নাব্যতা হারানোর ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর অনেক অংশই শুকিয়ে যায়। এতে পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয় নিচু অঞ্চল। গোমাই নদী যখন সচল ছিল তখন এ রকম পরিস্থিতির তৈরি হতো না।
পাইকুরাটি ইউনিয়নের সুনই গ্রামের বাসিন্দা মো. শাহজাহান খান নয়ন বলেন, আমাদের এসব নদী খনন হলে এলাকার মানুষের অনেক ভালো হবে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কারণে এলাকার চাষিদের জমিতে পানি দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় বাঁধ ভেঙে জমি তলিয়েও যায়।
মধ্যনগর বাজার ধান-চাল আড়ত কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জহিরুল হক বলেন, মধ্যনগর বাজার থেকে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মণ ধান বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ হয়ে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ধানগুলো সংগ্রহ করা হয়। নদীতে পানি না থাকার কারণে পণ্য পরিবহনে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে, আর কম দামেও পণ্যগুলো বিক্রি করতে হয়। নদী খননের জন্য সংশ্লিষ্টদের অবগত করেছি। আমরা সোমেশ্বরী নদীর শানবাড়ি থেকে মধ্যনগর হয়ে কলমাকান্দা পর্যন্ত অচিরেই খনন চাই।
মধ্যনগর বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেন তালুকদার বলেন, আমাদের পূর্ব-উত্তরের পাহাড় এলাকায় বৃষ্টি হলে পানি নদী দিয়ে নিচে নামে। নদী ভরাট হওয়ার ফলে মেঘালয় থেকে নামা পানি বাধার সম্মুখীন হয়। যেখানে বাধা পায়, সেখান থেকে পানির স্রোত ফুলতে থাকে। এ কারণেই হাওর ডুবে যায়। তিনি বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা বলেছেন এই গোমাই নদী যখন সচল ছিল উত্তরের পানি কংস নদে সহজেই চলে যেত। এই পানি কংস হয়ে গাগলাজুড়ি হয়ে নিচে নেমে যেত। এভাবেই আমাদের হাওরগুলো নিরাপদ থাকত। কৃষির প্রাণ-বৈচিত্র্যের অনন্য জনপদ হাওরাঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ পরিপূর্ণ। এই হাওরাঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। এই কৃষির প্রাণ-বৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে নদীকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই নদীগুলো গারো ও মেঘালয় পাহাড় থেকে বয়ে একদম সাগরে মিশেছে। নদীর প্রবাহ কমছে কারণ এর নাব্যতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ ও সড়ক নির্মাণ। এগুলো খুব পরিকল্পনা করে করতে হবে। নদী না বাঁচলে হাওর বাঁচবে না। আর হাওর না বাঁচলে প্রকৃতি, সংস্কৃতি, মিঠাপানি, মাছের স্বর্গরাজ্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাই নদী খনন জরুরি।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, সুনামগঞ্জে ১৪টি নদী পুনর্খনন করা হবে। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব নদী খনন করা হলে সুনামগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা আগাম বন্যা থেকে রক্ষা পাবে। তবে খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তাবিত এই নদীগুলো খনন করা সম্ভব হবে।