দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ নির্দেশনা, তৎপর ৩ মন্ত্রণালয়

বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচনায় মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য। এ দুটি বিষয় নিয়ে সরকারও রয়েছে প্রচণ্ড চাপে। এমন বাস্তবতায় মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা এবং সরকারি শূন্যপদ পূরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোট ১৫টি নির্দেশনা দেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সংশ্লিষ্টদের এসব নির্দেশনা প্রতিপালন করতে বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনার পরই সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটো এমনকি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে।

এসব নির্দেশনার প্রতিফলন বাজারে দেখা শুরু হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা ইতিবাচক। ইতোমধ্যে বাজারে তেল ও চিনির দাম কমতে শুরু করেছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখে চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। খেজুরের দামও কমে যাবে। পেঁয়াজ আমদানি হতে যাচ্ছে। এতে আরও দাম কমে যাবে। চাল ও আলুর দাম কমতে শুরু করেছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর দাম কমবেশি হওয়া। এসব পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম আরও কমে যাবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনি ইশতেহার-২০২৪ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জাতীয় বাজেট প্রণয়নকালে নির্বাচনি ইশতেহার-২০২৪ বিবেচনায় রাখবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চারটি স্তম্ভ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট জনগণ নিশ্চিত করতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে করণীয় চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে, নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকল্পের উপকারিতা ও দেশের জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তা গ্রহণে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। এ ছাড়া চলমান প্রকল্প বিশেষ করে যেগুলোর বাস্তবায়ন সর্বশেষ পর্যায়ে রয়েছে সেগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের শূন্যপদে দ্রুত জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান ও প্রবেশে সহায়তা করতে হবে। গার্মেন্টস সেক্টরের মতো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্যবিষয়ক শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে-শিক্ষাকে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে আইসিটি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যুবসমাজকে খেলাধুলা এবং শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে বিরত রাখতে হবে। অগ্নি-সন্ত্রাস ও নাশকতার বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দেওয়ার পর সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কথায় কথায় কাউকে (ব্যবসায়ী) ধমক দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পজিটিভ অ্যাকশনে যেতে হবে। রাজস্ব বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে আমদানি ও রপ্তানির ব্যয় কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রাজশাহী, নওগাঁর, বগুড়া ও কুষ্টিয়ায় সংশ্লিষ্ট মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে বলেছেন, দেশে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের জিরো টলারেন্সে রয়েছে। অবৈধ পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা করা থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অবৈধ মজুতদারদের শুধু জরিমানা করেই ছাড় দেওয়া হবে না, সংশোধন না হলে তাদের জেলেও যেতে হবে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ মজুত করে কৃত্রিমভাবে যাতে দাম বৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে আমাদের নজর রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাজার নজরদারি শুরু হয়েছে। আমদানিকারক, লোকাল উৎপাদক, কৃষি বিভাগ, খাদ্য বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগসহ সকলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’ তারা বলেছেন, রমজান উপলক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ মজুত আছে। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত থেকে পেঁয়াজ ও চিনি আমদানি করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণের সুদের হার আরও বাড়াতে পারবে। একই সঙ্গে যেসব ঋণ বিতরণের পর থেকে ছয় মাস উত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলোর সুদ হারও বাড়াতে পারবে। সরকারি খাতের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হার জানুয়ারি মাসে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোও এখন ওই সুদ হার বাড়াতে পারবে।