ডলার সংকট কাটাতে অনেক কৌশলের মধ্যে রফতানি বাড়ানো অন্যতম। বর্তমান রিজার্ভ খরচ না করে সরকার রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে আরও ডলার আয় করতে চায়। এজন্য রফতানি বাড়ানোর নতুন নতুন কৌশলের কথা ভাবছে সরকারের নীতি নির্ধারকরা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, রফতানি বাড়াতে নতুন নতুন খাতে সরকারের নগদ সহায়তা প্রদান এবং এ সুবিধা প্রাপ্তিতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা সহজীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যেসব খাতে সমানভাবে প্রণোদনা দেওয়া হলে রফতানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে সেগুলোকে চিহ্নিত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পরামর্শেই সরকার এ কাজটি শুরু করেছে বলে জানা গেছে। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই) ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি সংক্রান্ত নগদ সহায়তা সংশ্লিষ্ট এফই সার্কুলারগুলোর ওপর নলেজ শেয়ারিং’ শীর্ষক একটি সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, রফতানি বাড়ানোর খাতিরে সরকারকে দেওয়া পরামর্শে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় খাত যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, হালকা প্রকৌশল, পাটজাত ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক, বাইসাইকেল ইত্যাদি খাতে রফতানির ক্ষেত্র উন্নতি হচ্ছে। তাই এসব খাতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া গেলে রফতানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। প্রণোদনার ওপর থেকে কর আদায় প্রত্যাহার করা উচিত বলেও পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রচলিত খাতের বাইরে নতুন নতুন খাতকে নগদ প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত করা ও এটির প্রক্রিয়া আরও সহজ করারও পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পোশাক খাত ছাড়াও অল্প পুঁজি ও ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনার পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতা দূর করা প্রয়োজন। এজন্য ইপিবিকে চাহিদা চিহ্নিতপূর্বক নীতিসহায়তা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করারও পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার বেসরকারি খাতের উন্নয়নে যেসব সহযোগিতা দিচ্ছে, তা বেশি করে প্রচার করতে হবে যাতে উদ্যোক্তারা এ সম্পর্কে জানতে পারে এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে পারে। নগদ প্রণোদনা প্রদানের প্রক্রিয়াটি অটোমেশনে রূপান্তরের বিবেচনারও অনুরোধ করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬৭ বিলিয়ন (৬ হাজার ৭০০ কোটি) ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার। সারাবছর পণ্য ও সেবা রফতানি থেকে এ পরিমাণ আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সার্বিক রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ। পণ্য রফতানি খাতে নতুন আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৫৮ বিলিয়ন ডলার। আর সেবা খাতে ৯ বিলিয়ন ডলারের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রফতানি বাণিজ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান হারে রফতানি আয় বাড়লেও দেশে পণ্য বহুমুখীকরণের গতি খুবই ধীর। নতুন পণ্যের প্রসারে তেমনভাবে এগিয়ে আসছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে ঘুরে ফিরে কয়েকটি পণ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রফতানি বাণিজ্যে। প্রচলিত বাজারের বাইরে ভিন্ন কোনও বাজারও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রফতানি আয়ের ৯০ ভাগই আসছে ৪ ধরনের পণ্য থেকে। এরমধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই আসছে ৮০ ভাগ। বাকি ১০ ভাগ আসছে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য কতিপয় পণ্যে রফতানি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। দেশের রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতেই রফতানি পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে এই নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, শুধু তৈরি পোশাক খাতকেই সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। নগদ সহায়তার অর্থও পাচ্ছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। অথচ এর বাইরেও বাংলাদেশের অনেক পণ্য রয়েছে, যা বিদেশে রফতানির সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এসব পণ্যের চাহিদাও রয়েছে। সরকার এবার এসবের দিকে নজর দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান জানিয়েছেন, সরকার রফতানিকারকদের ব্যয় কমানো ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। সরকার ৪২টি পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ প্রণোদনা দেয়। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য রফতানি বাড়ছে এবং এ খাতে রফতানির পরিমাণ প্রায় ৯০০ কোটি ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায় তৈরি পোশাকের বাইরে দেশের রফতানি বাড়াতে আরও যেসব পণ্যের রফতানিকে উৎসাহিত করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশি দামের তৈরি পোশাক ও গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, সফটওয়্যার ও আইটি এনাবল সার্ভিসেস এবং আইটি পণ্য, ওষুধ, জাহাজ, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, কৃষিপণ্য ও এগ্রো প্রসেসড পণ্য, আসবাবপত্র, হোম-টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল, হোম ফার্নিশিং ও লাগেজ।
রফতানি বাড়াতে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত ১৪ পণ্য হচ্ছে- বহুমুখী পাটজাত পণ্য, ইলেক্ট্রনিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য, সিরামিক পণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য (অটো পার্টস ও বাইসাইকেলসহ), মূল্য সংযোজিত হিমায়িত মৎস্য, পাঁপড়, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, অমসৃণ হীরা ও জুয়েলারি, পেপার ও পেপার পণ্য, রাবার, রেশমসামগ্রী, হস্ত ও কারুপণ্য, লুঙ্গিসহ তাঁতশিল্পজাত পণ্য ও নারিকেলের ছোবড়া।
এছাড়াও সিরামিক, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, আসবাবপত্র, গরু-মহিষের হাড়, নারিকেলের ছোবড়া, আইটি পণ্য, কুইচ্চা মাছ, শাকসবজি, হালাল মাংস ইত্যাদিকে বলা হচ্ছে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত। তবে এসব খাতে সরকার নগদ সহায়তা দিচ্ছে না। এসব পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা পাওয়া গেলে রফতানি বাণিজ্য আরও সমৃদ্ধ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)জানিয়েছে, রফতানি নীতিতে চাকরিসহ ৩০ খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ পণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ১৪ পণ্যকে উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।