সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামটি একেবারেই অজপাড়াগাঁ। ওই গ্রামের বাসিন্দা নুর আলী। যিনি পেশায় একজন দিনমজুর। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আট সদস্যের পরিবার তাঁর। টানাপোড়েনের কারণে পরিবারের বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরমফিলাপ করতে পারিনি। অভাবের সংসারে মেয়েকে বেশিদিন তাই ঘরে রাখা হয়নি। কিছুদিন পর বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার।
তবে বড় ছেলে মিজানুরের কাছে দারিদ্রতা বাঁধা হতে পারিনি। অভাব-অনটনকে পেছনে ফেলে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তবে এমন ভালো রেজাল্টেও স্বস্তি মিলছেনা তার। উল্টো মাথায় যেন রাজ্যের যত চাপ চেপে ধরেছে তাকে।
গ্রাম ছেড়ে শহরের ভালো একটি কলেজে পড়ালেখা করার ইচ্ছা যে তার। কিন্তু শহরে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তার পরিবারের নেই। কিভাবে তা যোগাড় হবে এ নিয়ে শঙ্কিত মিজানুর ও তার পরিবার।
যদিও গ্রামে থাকতে অনেক কাজের সুযোগ ছিল মিজানুরের হাতে। কখনো মাঠে গিয়ে শ্রমিকের কাজ কখনো নদীতে বালু তোলার কাজ আবার কখনো মুদি দোকোনে করেছে কর্মচারীর কাজ। কিন্তু শহরে গিয়ে কাজ করার এমন সুযোগ মিলবে কি-না মিজানুরের ভাবনাতে এ বিষয়টিই ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার।
মিজানুর বলেন, করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় অলস কাটতো তার। তখন সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। পরিবারের জন্য কিছু করার তাগিদে পাড়ি জমায় রাজধানী ঢাকায়। সেখানে একটি মুদির দোকানে কাজ নেয় সে। তিনমাস কাজ করে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। পরে গ্রামের প্রতিবেশী এক মামার সঙ্গে রাজমিস্ত্রীর কাজে নামে মিজান। পড়ালেখার ফাঁকেফাঁকে দীর্ঘ এক বছর রাজমিস্ত্রির কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ ও পরিবারকে সহায়তা করে যায় মিজানুর।
২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কাজটা আর চালিয়ে যেতে পারিনি সে। কাজ না থাকায় হাতে কোনো টাকাও ছিলনা। কিছুদিন পর শুরু হয় এসএসসি পরীক্ষার ফরমফিলাপ। সেই টাকা ঋণ করে ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাকে।
নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে মিজানুর আরও বলেন, প্রাইভেটে পড়ার চেয়ে ক্লাসেই বেশি মনোযোগী ছিলাম। অন্যরা প্রাইভেট পড়লেও টাকার অভাবে আমি পড়তে পারিনি। পরীক্ষার তিনমাস আগে স্থানীয় এক ইংরেজি শিক্ষকের নিকট পড়তে যাই। স্যার অবশ্য আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি।
মিজানুর স্বপ্ন দেখে, দেশের নামকরা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন পড়ালেখা করবে। এবং বিসিএস পাশ করে প্রশাসনিক ক্যাডার হবার সুপ্ত বাসনা তার মনে। মিজানুর বিশ্বাস করে, একদিন তার স্বপ্নকে বাস্তবে ছুঁতে পারবে।
মিজানুরের দিনমজুর বাবা বর্তমানে ধান কাটার কাজে নরসিংদীতে অবস্থান করছেন। যোগাযোগ করলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ফল বের হওয়ার পর ছেলে আমারে কল দিয়ে বলছে, আব্বা আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। কিন্তু জিপিএ-৫ কি জিনিস তা না বুঝে ছেলের কাছে জানতে চেয়েছি, রেজাল্ট বেশি ভালা না কম ভালা তা কও, ছেলে তখন বলল, রেজাল্ট বেশি ভালা করছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলেটা পরিবারের অভাব দূর করার তাগিদেই পড়ার ফাঁকেফাঁকে কাজে বের হতো। ছেলের ইচ্ছা শহরে গিয়ে ভালো কোনো কলেজে পড়ার। কিন্তু এত টাকা কই পামু সেটাই ভাবতেছি।‘
মিজানুর যে স্কুল থেকে এবার এসএসসি পাশ করেছে ওই এমএ জাহের উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ বলেন, মিজানুর ছাত্র হিসেবে খুবই পরিশ্রমী। পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে তাকে প্রায়ই দিনমজুরের কাজে বের হতে হত। যে কারণে নিয়মিত স্কুলে আসা হয়নি তার। তবে সে মেধাবী। যে কারণে পড়ালেখা কম করেও মানবিক থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পড়ালেখা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারলে একদিন সে ভালো কিছু করবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।