সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার চিলাউড়া-হলদিপুর ইউনিয়নের রসুলপুর জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তিনিই নন, এই প্রতিষ্ঠানে আরও দুইজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এদিকে সহকারী সুপার তাজুল ইসলাম ও অপর দুইজন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সুপারিনটেনডেন্ট মো. নাছির উদ্দিন।
জানা গেছে, রসুলপুর জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় সরকারি বিধি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের ১১ জানুয়ারি সুপার পদে নিয়োগ পান মো. নাছির উদ্দিন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে অনুমোদন লাভ করে এবং এমপিওভুক্তির সকল কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু আলোর পথ দেখার আগেই সুপারের বিরুদ্ধে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। অবশেষে তাজুল ইসলামের প্ররোচনায় কমিটির কতিপয় লোকজন ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর সৃজিত পদত্যাগপত্র নিজেরাই তৈরি করে এই পদ থেকে সুপার নাছির উদ্দিনকে জোড়পূর্বক অব্যাহতি দিয়ে মাদ্রাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় নানা কৌশলে চাকরি বাণিজ্য।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী আনোয়ার হোসেনের যোগসাজশে ম্যানেজিং কমিটির কতিপয় লোকজন কাগজে-কলমে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও ইন্টারভিউ বোর্ডের নামে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী সুপার হিসেবে তাজুল ইসলাম ও ২ জন সহকারী শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপত্রে সহকারী সুপার হিসেবে তাজুল ইসলামকে বিগত ২০০৩ সালের ১ জুলাই, সহকারী মৌলভী পদে মো. আব্দুল মান্নানকে ২০০০ সালের ১ এপ্রিল ও সহকারী শিক্ষক পদে একই তারিখে আ ব ম আমিনুল হককে নিয়োগ দেখানো হয়। যেখানে ছাড়পত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির সুপার নাছির উদ্দিন ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন এবং এবতেদায়ী প্রধান হিসেবে তাজুল ইসলামও কর্মরত। যার প্রমাণ বেতন বিলি, হাজিরা খাতাসহ বিভিন্ন অফিসিয়াল দপ্তরে বিদ্যমান রয়েছে।
এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ২০০৩ সালে সহকারী সুপার পদে তাজুল ইসলাম কিভাবে কর্মরত থাকেন? সুপার নাছির উদ্দিনকে বিদায় করার প্রায় ১২ বছর পূর্বে শূন্য পদ দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী সুপার তাজুল ইসলামকে নিয়োগ দেখানো হয়েছে। অথচ ১৯৯৮ সালের ১২ ডিসেম্বর এবতেদায়ী প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠানে তাজুল ইসলাম ও অপর দুই শিক্ষককে নিজ স্বাক্ষরে চাকরি দিয়েছিলেন সুপার মো. নাছির উদ্দিন।
বিভিন্ন সূত্রমতে জানা গেছে, কমিটির কিছু অসাধু ব্যক্তির সহযোগিতায় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সুকৌশলে বিধিবহির্ভুতভাবে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব হাতিয়ে নেন বিতর্কিত সহকারী সুপার মো. তাজুল ইসলাম। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়। যদিও নিয়ম মোতাবেক এবং বিধি অনুসারে ইবতেদায়ী প্রধান তাজুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সুপার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০০৩ সাল থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী সুপার হিসেবে সুযোগ-সুবিধা ও ২০১৯ সাল থেকে সরকারি বেতন-ভাতা হাতিয়ে নেওয়া তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি অদৃশ্য খুঁটির জুড়ে ভারপ্রাপ্ত সুপারের চেয়ারে রয়েছেন বহাল তবিয়তে- এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সুপার হিসেবে মো. নাছির উদ্দিনের নাম অনলাইনে এখনও বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। এছাড়া অপর শিক্ষক আব্দুল মান্নান ও আমিনুল হকের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম-নীতির প্রতি তোয়াক্কা না করে তাদেরকেও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এসব অপকর্মে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম মোখলেছুর রহমান ও কর্মচারী আনোয়ার হোসেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হলে পূর্বোক্ত সমস্ত প্রমাণাদি গায়েব করে নতুনভাবে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও ইন্টারভিউ বোর্ড ও স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে শূন্য পদে সহকারী সুপার ও আরও ২ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেখানো হয়েছে বলে ভুক্তভোগী সুপার নাছির উদ্দিন দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই তিনজন শিক্ষক উল্লেখিত তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি বলেও সরেজমিনে পরিদর্শন ও লিখিত অভিযোগে উঠে আসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদ্রাসা কমিটির এক সদস্য জানান, ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করে ভুয়া রেজুলেশনের মাধ্যমে সুপার নাছির উদ্দিনসহ নিয়োগ বোর্ডের সকল সদস্যের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে তাজুল ইসলামকে সহকারী সুপার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলেও মনে করে এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম মোকলেছুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ভিত্তিহীন। বিভিন্ন দপ্তরে আনিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করেছি। এরই ভিত্তিতে রির্পোট তৈরি করা হয়েছে।
অভিযুক্ত সুপার (ভারপ্রাপ্ত) তাজুল ইসলাম বলেন, আমার ওপর দাখিলী অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। মাদ্রাসার বিষয়টা গ্রামের, তাই আমি কিছু বলতে পারব না।
নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নানা টালবাহানা শুরু করেন। এসময় তিনি কাগজপত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে ও আরেকটি সেট তার বাড়িতে রয়েছে বলে তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, নাছির উদ্দিন বারবার ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের করছেন।
মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি আনোয়ার মিয়া বলেন, এটি বহু আগের বিষয়। এত কিছু আমি বলতে পারব না। তিনি (নাছির উদ্দিন) মাদ্রাসার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন এটা সত্য। কেন তাঁকে হঠাৎ করে বিদায় করা হলো সবকিছু আমার মনে নেই।
সুপারিনটেনডেন্ট মো. নাছির উদ্দিন বলেন, বেতন-ভাতা ও চাকরিতে পূনর্বহালের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে লিখিত আবেদন করেছি। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে বিনা নোটিশে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে অভিযুক্তদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিরূপায় হয়ে আমি জগন্নাথপুর থানায় লিখিত অভিযোগ ও জিডি এন্ট্রি করেছি, যার নম্বর ১৪৭৫। বর্তমানে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। মাদ্রাসার নিজস্ব তহবিলের লাখ লাখ টাকা অপচয় করে তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি শিক্ষাবান্ধব সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার কামনা করছি।