চা শ্রমিক পাখি নায়েক। কাজ করছেন সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে। নিজের ৯০ বছর পেরিয়ে গেলেও পেটের দায়ে চা বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। শুধু পাখি নায়েকই না, প্রায় দুশো’ বছরের বঞ্চনা আর শোষণের সাক্ষী পাখি নায়েকের মতো আরও অনেকে।
জীবন বদলানোর জন্য যে চা শ্রমিকরা বাংলাদেশে এসেছিলেন, তারা এখন জীবন বদলানোর পরিবর্তে জীবন চালানোর লড়াইয়েই দিন পার করছেন। তাদের কাছে দিন শেষে সর্বনিম্ন মজুরী নিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার নামই জীবন।
দীর্ঘ ৯০ বছর থেকে সেই বেঁচে থাকা লড়াইয়ে থাকা পাখি নায়েক নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে জানান, ‘এই বয়সে আমার ঘরে বিশ্রামে থাকার কথা। কিন্তু অভাবের কারণে ঘরে থাকতে পারছি না। কাজ করতে হয়। কাজে যেতে হয়। আমরা একবেলা খাবার খেলে আরেকবেলা খাবার পাই না। নতুন একটা কাপড় কিনতে পারি না আমি। ছেঁড়া কাপড় পরে থাকি। সন্তানদের শান্তিতে রাখতে পারি না।’
পাখি নায়েক বলেন, ‘বাসায় ফেরার পর সন্তানরা যখন ভালমন্দ খাবার খাওয়ার আবদার করে তখন নিজেকে ব্যর্থ বাবা মনে হয়। কিভাবে কি করবো বলেন। ঘরের মধ্যে ঘুমানোর মত খাট নেই, বসার মত চেয়ার নেই। বাঁশের তৈরি একটা চাটাই কেনার সামর্থ্য নেই যে মাটিতে বিছিয়ে ঘুমাবো। সেজন্য মাটিতে বস্তা বিছিয়ে ঘুমাতে হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে আমি নিজেই তো অচল অবস্থায় আছি। কাজ করতেই তো আমার কষ্ট হচ্ছে। কাজ করলে খেতে পারছি আর না করলে পারছি না। এভাবেই সন্তানদের নিয়ে আমাদের চা শ্রমিকদের জীবন চলছে।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে না পারছি বাচ্ছাদের ভালমন্দ খাওয়াতে, না পারছি কাপড়-চোপড় কিনে দিতে অন্যদিকে না পারছি স্কুলে পড়াতে। কিন্তু সরকার আমাদের না বেতন বাড়াচ্ছে না রেশন। আমরা চলবো কিভাবে? এসব নিয়ে কার কাছে যাবো? কে আমাদেরকে শান্তি দিবে?’
শুধু ৯০ বছর বয়সী পাখি নায়েক নয়, চা বাগানের শ্রমিকদের গল্পগুলো এরকমই। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যাদের।
নিজেদের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে দিপা বাউরি বলেন, ‘এই রাস্তায় রোদে পোড়ে না খেয়ে আমরা আন্দোলন করছি। এর কারণ কিন্তু একটাই- আমরা চা শ্রমিকরা ভাল নেই। যুগের পর যুগ আমরা আমাদের এত কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে নিজেদের জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। বর্তমান সময়ে এসে আমরা আসলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরা আর এসব কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।’
শুধু দিপা বাউরিই নয়। বাগানের সব চা শ্রমিকের মনের কথা এটি। দীর্ঘ ১৮ দিন আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সকলের মনের কষ্টের বহিঃপ্রকাশ এটি।
চা শ্রমিকরা বলেন, ‘বৃটিশ গেল, পাকিস্তান গেলো আমরা কিন্তু এখনও সেই শোষণের মধ্যেই রয়ে গেছি। এই ১২০ টাকার মধ্যে আমরা কিভাবে আমাদের সন্তানদের খাওয়াবো, কিভাবে পড়াশোনা করাবো আপনারায় বলে দিন?’
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সেবা, চিকিৎসা মৌলিক চাহিদার কোনটিই ঠিক মতো পূরণ হয়না এসব চা শ্রমিকদের। শ্রম বিধিমালা অনুয়ায়ী মালিকপক্ষ প্রত্যেক শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বাসস্থান নিশ্চিত করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ৩০ হাজারেরওে বেশি শ্রমিকদের জন্য আবাসন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যারা বরাদ্দ পেয়েছেন তাও পর্যাপ্ত নয়। নিয়ম থাকলেও সকল চা বাগানে নেই প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধা।
এদিকে এতদিন চা শ্রমিকরা একাই আন্দোলনের মাঠে থাকলে বৃহস্পতিবার বাড়তি মজুরির দাবিতে মা বাবার সাথে রাস্তায় নামে তাদের শিশুরাও।
৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে টানা আন্দোলনের পর ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা মজুরি দিতে রাজি হয়েছে চা মালিকপক্ষ। কিন্তু ৩০০ টাকা মজুরির জন্য এখনও শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
চা শ্রমিকদের নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘চা শ্রমিকরা এই দেশে থেকেও তারা পরবাসী। এই দেশেরই তারা নাগরিক কি না সেটা নিয়েও কিন্তু চা শ্রমিকদের একটা দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কেননা, আমাদের দেশের প্রচলিত শ্রম আইন, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা, আমাদের দেশ এখন অনেক দিক থেকে উন্নত হয়েছে। অবহেলিত মানুষজন অনেক জায়গা থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চা শ্রমিকরা কিন্তু সেটা পাচ্ছে না। এসব কারণেও কিন্তু তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। চা শ্রমিকদের জীবনমানোন্নয়নে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন এই আশায় এাখনও বুক বেধে আছেন চা শ্রমিকরা।