সময়টা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। পাগলার দক্ষিণের হাওরে পানি আর পানি। দখিনা বাতাসে আফালের তর্জন-গর্জন। ঘরে পানি ঢুকবে কোনোদিন ভাবেনি। প্রতিদিনকারমতো সেদিনও রাত ১০টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। ১টা থেকে ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। কি করবো। বাড়িতে পুরুষ লোকও নেই। একমাত্র কিশোর ছেলে। ঘরে প্রতিবন্ধী ছোট বোন। প্রবল গতিতে বাতাস বইছে, সেই সাথে আফালের কী আস্ফালন! ভাঙা ঘরের পূর্ব ও দক্ষিণের ভেড়া ততক্ষণে তছনছ হয়ে গেছে। ঘরের পানি হাঁটুর সমান হয়ে যাচ্ছে। একটি কক্ষেই তিনটি চৌকি, রান্না ঘর। ঢেউয়ে সব কিছু এলোমেলো করে ফেলেছে। আমার কান্না চলে এসেছে। আল্লাহকে ডাকছি আর চিৎকার করে কান্নাকাটি করছি। বৃষ্টি-বাতাসে আমাদেরকে অসহায় করে দিয়েছিলো। সেদিন মনে হয়েছিলো আর বাঁচবোই না। পাশের এক আত্মীয় রাতের আঁধারে আমাদের বের করে নিয়ে যান তার বাড়িতে। সব কিছু ফেলে জান নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে দেখি ঘরের চালের সাথে পানি। ঘরের কোনো বেড়াই নেই। চৌকি, মিসরিব (কাপড়, কাপ-পিরিচ রাখার বাক্স বিশেষ), কলস, হাঁড়ি-পাতিল কোনো কিছুই নেই। কয়েকটি ভাঙা বাঁশের উপর কোনো ক্রমে ঘরের চালটি দাঁড়িয়ে আছে।’ এভাবেই গত বছরের বন্যার বিভীষিকাময় দিনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মধ্যবয়সী বিধবা গৃহকর্মী সোহেনা বেগম। তিনি আরো বলেন, সেসব ভয়াবহ সময়ের কথা মনে হলে মন চায় হাউমাউ করে কাঁদি। শরীরে কাঁপন ধরে; ভাবলেই লোম দাঁড়িয়ে যায়। আর কখনো এমন দিন দেখার কল্পনাও করতে পারেন না তিনি। তবে, যখন আকাশে মেঘ জমে, হাওরে পানি প্রবেশের খবর শোনা যায় তখন মলিন হয়ে উঠে তার মুখ। এমন দুর্বিষহ দিন দেখতে চান না আর।
তিনি জানান, বন্যার পর একসপ্তাহ পরে যখন বাড়িতে এসেছেন তখন তার আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। ঘরের যে চাল দাঁড়ানো ছিলো বন্যা পরবর্তী তুফানে সে চালও উপড়ে গিয়েছিলো৷ আত্মীয়দের সহায়তায় কোনোক্রমে চালকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এমন দুরূহ দিনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় সরকারিভাবে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন তিনি। এই টাকা তার জন্য ‘সাঁতারে জিরিয়ে নেওয়ার’ মতো কাজ করেছিলো। সে টাকায় কিছু টিন, বাঁশ কিনে আনেন। পরে শ্রমিক ধরে কোনো রকমে ঘরকে দাঁড় করিয়েছিলেন। ১০ হাজারে সম্পূর্ণ কাজ না করাতে পারলেও ঘরের চাল ঠিক করিয়েছিলেন। চারপাশের বেড়া তিনি ছালা দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। বাকী টাকার ব্যবস্থা করতে না পেরে এখনো বসবাস করছেন ছালার বেড়ার ঘরে।
সোহেনা বেগম শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী রমিজ আলীকে হারিয়েছেন ৬ বছর আগে। একমাত্র সন্তান শান্তিগঞ্জের একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে টানাপোড়নে কোনো রকমে চলছে তার দুঃখের সংসার। শারিরীক প্রতিবন্ধীতার কারণে ছোট বোন সেলু বেগম (৩৫) আজও অবিবাহিত রয়ে গেছেন।
গত বন্যার চিরধরা দুঃখের এমন ইতিহাস আর লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা শুধু সোহেনা বেগমেরই নয়। শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের এমন শতাধিক সোহেনা বেগমরা আছেন যাদের গেল বন্যা এখনো টাটকা দুর্বিষহ স্মৃতি। কত সম্পদ, ঘরবাড়ি, আত্মীয় আর সন্তান সমতুল্য গৃহপালিক পশুকে হারানোর স্মৃতি স্মরণ করে আজও ভিতরে ভিতরে ঢুকরে কাঁদে অনেক কৃষক। খাদ্য আর জায়গার সংকটে পানির দরে বিক্রি করতে হয়েছিলো প্রিয় গরুকেও। ঘরের বাইরে বেরোয়নি যে কিশোরী তাকে নিয়েও রাস্তার ধারে দিনরাত্রি যাপন করতে হয়েছে মা-বাবার। কত মসজিদ মন্দির আশ্রয়স্থান হয়েছে হাজারো মানুষের তার কোনো হিসাব নেই। একমুটো চালও যিনি ধার করে খাননি কখনো তাকেও নিতে হয়েছে অন্যের ত্রান।
এতোদিন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও বৃষ্টি ছিলো না। গত বছরের এই দিনে সুনামগঞ্জ জেলা পুরোপুরিভাবে প্লাবিত হয়ে যায়। তার এক বছর পূর্তির দিনেও পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাতে পানি বাড়ছে জেলার নদ নদীগুলোতে। এতে জনসাধারণের মুখ মলিন হচ্ছে, বাড়ছে চিন্তা। কেউ কেউ মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন বন্যা মোকাবিলার। বেশিরভাগই বিষয়টিকে ছেড়ে দিয়েছেন ভাগ্যের উপর। তবে দু:শ্চিন্তা আছে সকলের।
পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের কৃষক আবদুর রহিম জানান, আমরা হাওর এলাকায় থাকি। বন্যার সাথে আমাদের পুরোনো সম্পর্ক৷ বন্যাকে মোকাবিলা করেই বেঁচে আছি। তবে, গেল বারের মতো বন্যা কখনো আশা করি না। গত বছরের কষ্টের দিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়।
সিলেট ভয়েস/এএইচএম