মোটে ৫০০ লোকবল নিয়ে হিমশিম খাওয়া সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে সাম্প্রতিক আন্দোলনে গত ১৭ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৪ জন রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। হাসপাতালে তাদের পরিচয় ‘কোটা আন্দোলনের রোগী’। বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাদের বেডের সাথে সাদা কাগজে কালো হরফে এই পরিচয়ই দেখা গেছে।
হাসপাতালের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার (১৪ আগস্ট) পর্যন্ত ৪৮ জন রোগী শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি ও আঘাতের চিহ্ন নিয়ে ভর্তি আছেন।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আহত হয়ে ভর্তি আছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কারো মাথায় গুলি, কারো চোখে, কারো পিঠে কিংবা কারো হাতের কনুই, কব্জিতে পায়ের গোড়ালিতে কিংবা উরুতে এক বা একাধিক আঘাতের ক্ষত।
সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের জয় টেইলার্সের মালিক অতীশ সূত্রধরের (৫০)। সাম্প্রতিক সহিংসতায় গত ৫ আগস্ট দুপুরে তার গলা, হাত-মাথায়ও অসংখ্য গুলি লাগে। অথচ তিনি কোনো আন্দোলনে অংশ নেননি। দোকান লাগিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে দোতলায় নামলে নিচ থেকে গুলি করে পুলিশ।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭ নং ওয়ার্ডের ৪ নং বেডে শুয়ে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অতিশ, কী দোষ ছিল তার?
হাসপাতালে ৯ নং ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের একই পরিবারের দুই সহোদর বাহার উদ্দিন (২১) মামুনুর রশীদ(১৬)। বাহারের পায়ে উরুতে গুলি লেগে অপরপাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তার ছোট ভাই মামুনের দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে। দুজনেই ৫ আগস্ট বিকালে বিজয় মিছিল করতে গিয়ে পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হোন। শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিতের পরও সরকারি বাহিনীর হাতে তাদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বীভৎস স্মৃতি তাড়া করে তাদেরকে।
একইভাবে নগরের তালতলার বাসিন্দা সিদ্দেক মিয়ার ছেলে মো. রাশেদ আহমদ (২৩) পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হোন ৫ আগস্ট। সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে তার পায়ের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷
রাশেদের মা ইয়ারুন বেগম বলেন, ‘আমার বড় ছেলে আলাদা হয়ে নিজের সংসার চালায়। এই কারণে আমার ছেলে রাশেদ আমাকে রুজি রোজগার করে খাওয়াতো। আমরা জানি না কবে আমার ছেলে ভালো হবে! ডাক্তার বলছে আরেকটা অপারেশন লাগতে পারে।’
গোয়াইনঘাট এলাকার বাসিন্দা আরিফ উদ্দিন (১৭) গুলিবিদ্ধ হোন ৪ আগস্ট। আন্দোলনে বিএনপি’র পক্ষে মিছিলে যান তিনি। গুলি লাগে বাম হাতের কনুইয়ে। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলে তিনি আর কিছুই জানতে পারিনি। ঘন্টা দুয়েক পর নিজেকে আবিষ্কার করেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের কিশোর নুরুল ইসলাম সানী (২০) ৪ আগস্ট মিছিলে যান। নগরীর বাবনা থেকে মিছিল এসে লাউয়াই এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। তৎক্ষণাৎ তিনি কিছু বোঝেননি। তবে রাতে বাড়িতে ফিরে তার চোখ লাল দেখে সন্দেহ হয় তার। পরে ডাক্তার দেখালে তিনি জানতে পারেন তার চোখে এবং কানে গুলি লেগেছে। তার স্থান হয়েছে ওসমানী মেডিকেলে।
বাম চোখটা লাল হয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘চোখের ভিতরেই তো গুলি আটকে আছে। ডাক্তার বলেছে, অপারেশন করতে হবে৷ চোখ ভালো হবে কি না সে বিষয়ে ডাক্তারও আশাবাদি নন।’
বিএনপি কর্মী হিসেবে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হোন হোসেন আহমদ (২৭)। নগরের টুকেরবাজার এলাকায় ৫ আগস্ট মিছিল হলে পুলিশ গুলি করে। তার শরীরে ৩৬টি গুলির ক্ষতচিহ্ন! কেবল সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এসে দেখে গিয়েছেন। দলের হয়ে আর কেউ তাকে দেখতে আসেননি, অভিযোগ হোসেনের।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই রোগীদের চিকিৎসার্থে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সকল চিকিৎসকরা রোগীদের সেবাদানে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ভর্তি হওয়া প্রতিটি রোগীর জন্য অধ্যাপক দ্বারা গঠিত মেডিকেল বোর্ড তাদের চিকিৎসার যাবতীয় সেবা নিশ্চিত করছেন। চিকিৎসার যাবতীয় সেবা বিনামূল্যে পাচ্ছেন রোগীরা।’