যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজনীয় চাহিদা উল্লেখ করে সার্চ অপশনে ক্লিক করলেই সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিস্তারিত তথ্য মুহূর্তেই চলে আসবে। এরপর সেখান থেকে বাছাই করে অধিকতর যোগ্য কর্মকর্তা/কর্মচারীকে যথাস্থানে দ্রুত পোস্টিং দেওয়া সম্ভব হবে। এভাবে একজন গণকর্মচারীর চাকরি জীবনের সব বিষয়ে কম সময়ের মধ্যে সেবা নিশ্চিত করবে নির্ধারিত সিস্টেম বা ডিজিটাল পদ্ধতি। মূলত সিস্টেম থেকে ম্যান বা মানুষকে পুরোপুরি আলাদা করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশাল এক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। যে কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’। সংক্ষিপ্ত নাম ‘জিইএমএস’। তিন বছর মেয়াদি কর্মসূচির যাত্রা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে জাতীয় বেতন স্কেলের ৯ম গ্রেড অর্থাৎ ক্যাডার কর্মকর্তাদের এন্ট্রি পদ থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের গ্রেড-১ পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। এখানে বিদ্যমান ২৬টি বিসিএস ক্যাডার ছাড়াও এই ধাপে অবস্থানকারী সব কর্মকর্তা যুক্ত হচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে ২০ লাখ গণকর্মচারীর প্রত্যেকের যাবতীয় অফিসিয়াল তথ্য-উপাত্ত এই তথ্যভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এনআইডির মতো এই তথ্যভান্ডারে প্রবেশের এক্সেস দেওয়া হবে স্ব স্ব ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে। এছাড়া প্রতিটি ক্যাডারের আলাদা অ্যাডমিন থাকবে। তবে সুপার অ্যাডমিন থাকবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
কর্মসূচির রোডম্যাপ : মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও কাজের মূল্যায়ন পদ্ধতি আধুনিকায়নের লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে জিইএমএস কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। পরিচালক হিসাবে কর্মসূচির দায়িত্ব পেয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (পিএসিসি) মো. আ. রাজ্জাক সরকার। উপকর্মসূচির পরিচালকের প্রশাসন, অর্থ এবং নীতিমালা বিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন মন্ত্রণালয়ের সিপি-১ শাখার উপসিচব মো. দৌলতুজ্জামান খান। সফটওয়্যার ডেটাবেজের উপকর্মসূচির পরিচালক হলেন মন্ত্রণালয়ের পিএসসিসির সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান। গেল মার্চ থেকে কর্মসূচির কাজও শুরু হয়েছে।
এদিকে কর্মসূচির সার্বিক কাজ তদারকি করতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে পরিবীক্ষণ ও নীতিনির্ধারণী কমিটি। এছাড়া ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রশিক্ষণ (সিপিটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. সহিদউল্যাহর নেতৃত্বে রয়েছে ১১ সদস্যের কারিগরি কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কর্মসূচির ধারাবাহিক কাজগুলো যত দ্রুত এগিয়ে যাবে, তত এর সুফল পেতে শুরু করবে কর্মচারীরা। কাজ শেষ হলে যে কোনো সরকারি কর্মচারীদের বহুবিধ অফিসিয়াল তথ্য জানা যাবে এক ক্লিকেই। সাংগঠনিক কাঠামো ও পদসংখ্যা যথাযথভাবে নিরূপণ করা খবুই সহজ হবে। এপিএআর ব্যবস্থা অনলাইনে প্রণয়ন, দাখিল ও মূল্যায়নের সুবিধাও থাকছে। সহজ হবে শৃঙ্খলাসংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাপনার কাজও। নতুন পদ সৃষ্টি যেমন সহজ হবে, তেমনই অপ্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে। পেনশন ও পারিবারিক পেনশনপ্রাপ্তি সহজ হবে। সহজ হবে অডিট ব্যবস্থাপনা, কর্মচারী সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা এবং কর্মচারী ব্যবস্থাপনায় সরকারের পরিকল্পনার কাজ। কেউ কোনো ভুয়া তথ্য দিয়ে অতিরিক্ত কোনো সুবিধা নিতে পারবে না।
সবচেয়ে বড় কাজটি হবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে। যে কর্মকর্তা যে বিষয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষত ও দক্ষ, তাকে সেখানে পদায়ন করা হবে। এজন্য কাউকে তদবির করা লাগবে না। সিস্টিমে গিয়ে সার্চ করলে সংশ্লিষ্ট ক্যাটাগরির সব কর্মকর্তার তথ্য একসঙ্গে চলে আসবে। এর ফলে সঠিক স্থানে সঠিক কর্মকর্তাকে পদায়ন করা সহজ হবে। তখন কারও জন্য প্রাইজ পোস্টিং বলতে কিছু থাকবে না। কর্মসূচির আওতায় প্রায় ২০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সব তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের কাজ শেষ হলে বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে। তখন শুধু পোস্টিং নয়, যে কোনো সার্ভিস দেওয়া সহজ হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারের অনুমোদিত মোট পদের সংখ্যা ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। পদ শূন্য রয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ২ লাখ ৩৯ হাজার ১৫টি। কর্মরত আছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৯ জন। শূন্য আছে ৪৩ হাহার ৩৩৬টি পদ।
কর্মসূচির অগ্রগতি : জিইএমএস কর্মসূচির আওতায় সব মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে ৪টি কর্মশালার আয়োজন করে মতামত নেওয়া হয়েছে। এটুআই, বিসিসি, আইবাস, এনআইডি কর্তৃপক্ষ, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিডিসিসিএল প্রতিনিধিদের নিয়ে কারিগরি কর্মশালাও শেষ হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পিআইএমএস-এর বর্তমান তথ্য পর্যালোচনা এবং পিআইএমএস আধুনিকায়ন করা হবে এ মাসের মধ্যে। ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে নতুন তৈরি করা পিআইএমএস সম্পর্কে ৬ হাজার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ডেটা এন্ট্রি এবং পিআইএমএস চালু করা। আগামী বছর মার্চের মধ্যে বার্ষিক কজের রোডম্যাপ মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রোটোটাইপ তৈরি, গাইডলাইন প্রস্তুত এবং সব সরকারি দপ্তরের ডেটা সংগ্রহ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ ধরনের কর্মসূচি নেওয়ার অনেক আগে থেকে সরকার কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশে-বিদেশে বহুমুখী প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহায়তা দিচ্ছে। সংক্ষিপ্ত কোর্স ছাড়াও কর্মকর্তাদের ডিপ্লোমা, মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গত ১০/১২ বছরে অন্তত ৫ হাজার কর্মকর্তা এ সুযোগ পেয়েছেন। এর বাইরে অনেকে নিজ উদ্যোগে শিক্ষা ছুটি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। কেউ কেউ পিএইচডি ডিগ্রিও নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসে না। কেননা তারা যে বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ অর্জন করেছেন, সে অনুযায়ী তাদের অনেককে পোস্টিং দেওয়া হয় না। এছাড়া অনেকে আছেন সরকারি টাকায় প্রশিক্ষণের নামে প্রমোদভ্রমণের মতো শুধু বিদেশ সফর করেছেন। উদ্দেশ্য, ইউরোপের কোনো দেশে একসময় সপরিবারে থেকে যাওয়া। কিংবা গোপনে পিআর প্রসেস করে রাখা। আজকাল এমন কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ছে।
সূত্রমতে, বর্তমান সরকারের সময়ে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স করেছেন ৩ হাজার কর্মকর্তা। এর মধ্যে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব ধাপের কর্মকর্তা রয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব ১৫ দিন করে যুক্তরাষ্ট্রে, উপসচিবদের ২১ দিনের জন্য প্রশিক্ষণ অস্ট্রেলিয়ায়। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ কোর্স হয়েছে। এসব কোর্সে সচিবদের জন্য ১৫ লাখ, অতিরিক্ত সচিবদের ১২ লাখ, যুগ্মসচিব ৯ লাখ এবং উপসচিবদের জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ টাকা করে।
সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পর্যন্ত মাস্টার্স কোর্সে পাঠানো হয়েছে প্রায় ৭৫০ জনকে। মাস্টার্স কোর্স ১ থেকে দেড় বছরের জন্য। এ কোর্সে আগে খরচ হতো জনপ্রতি ৩৫ লাখ টাকা। এখন তা ৫০ লাখে উন্নীত হয়েছে।
ডিপ্লোমা ডিগ্রি করার জন্য লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় পাঠানো হয়েছে ১৪৯ জনকে। এসব কোর্স ছিল ৯ মাস বা এক বছরের। এ কোর্সে জনপ্রতি খরচ হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা।
সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিব পর্যায়ে পিএইচডি করানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১৩ জনের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪ বছরের জন্য ৭ জন বাইরে আছেন। বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। পিএইচডি করতে প্রত্যেকের পেছনে সরকারে ব্যয় হবে ২ কোটি টাকা করে।