কোন উচ্চাভিলাষের জন্য চা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেনি, তাদের এই দাবি ৩ বেলা পেটপুরে খেয়ে বেঁচে থাকার। তাদের এ দাবি অভুক্ত থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির। তাদের এ দাবি রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে চা বাগানে নিজের শরীরটাকে বিলিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নিজের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার। তাদের দাবিটা কি অযৌক্তিক? নিশ্চয় মালিকপক্ষ ছাড়া ২য় কোন পক্ষ এটাকে অযৌক্তিক বলার কথা নয়।
চা শ্রমিকরা কি দাবি করেছে? নগদ ১২০ টাকা থেকে দৈনিক মজুরিটা বাড়িয়ে যেন ৩০০ টাকা করা হয়। ২০২২ সালে এসে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করাটা নিশ্চয় অযৌক্তিক ভাবার কথাও না। বর্তমান বাজারের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে নিশ্চয় এই ৩০০ টাকাটাও মজুরি হিসেবে অনেক কম হয়ে যায়। কেননা, বর্তমান বাজারের হিসেবে সব থেকে নিম্নমানের চালের খুচরা মূল্য ৬০ টাকা, ডাল ১০০ টাকা, আলু ৩০ টাকা, লবন ৩৮ টাকা, কাঁচা মরিচ ২২০ টাকা, পেঁয়াজ ৪৫ টাকা, সয়াবিন তেল ১৮৫ টাকা।
একটি কর্মক্ষম নারী চা শ্রমিকের একার রোজগারে তার বয়স্ক বাবা, মা, অসুস্থ স্বামী, সন্তানসহ ৫ সদস্যের পরিবারে শুধুমাত্র রাতে একবেলা আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে হলেও দরকার কমপক্ষে দেড় কেজি পরিমাণ চাল, যার বাজার মূল্য সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা। ২৫০ গ্রাম পরিমাণ আলু, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৮ টাকা প্রায়, ১০ গ্রাম লবন প্রায় ৩ টাকা, ১০ গ্রাম কাঁচামরিচ ৩ টাকা, ১০ গ্রাম পরিমাণ শুকনা মরিচ ২ টাকা, ১০ গ্রাম পরিমাণ পেঁয়াজ ৬ টাকা, জ্বালানি খরচ বাবদ ৫০ টাকা (চা শ্রমিকরা কিন্তু লাকড়ির চুলায় রান্না করেন) লেগে থাকে। তাহলে হিসেব মতে এই ৫ সদস্যের পরিবারে আলুভর্তা দিয়ে রাতের খাবার বাবদ খরচ দাঁড়ায় (৭৫+৮+৩+৩+২+৬+৫০)= ১৪৭ টাকা।
এবার চলুন ডালভাত আর আলুভাজা দিয়ে তাদের একবেলা খাবারের খরচের পরিমাণটা হিসেব করে দেখি। তার আগে বলে নিতে চাই, চা শ্রমিকরা কিন্তু রাতের বেলার খাবারটায় মূলত পরিবারের সবাইকে নিয়ে পেট ভরে খেতে পারে। সম্ভব হয়ে থাকে। গুরুত্ব দিয়ে থাকে। চলুন তাহলে হিসেবটা করে নেওয়া যাক।
চা শ্রমিক এক রাঁধুনির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ৫ জন সদস্যের একটি পরিবারে ডালভাত খেতে হলে যা যা প্রয়োজন তা হলো- চাল দেড় কেজি। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা ধরলে দেড় কেজির মূল্য দাঁড়ায় ৭৫ টাকা। ৫ জনের জন্য আনুমানিক ডাল লাগবে ১০০ গ্রাম। যার মূল্য প্রায় ১২ টাকা, পেঁয়াজ ১০০ গ্রাম ৩ টাকা, রসুন ১০ গ্রাম ৮ টাকা, লবন ১০/১৫ গ্রাম ২/৩ টাকা। মরিচ আর হলুদ গুঁড়া মিলিয়ে ১০ টাকা। তেল ৫০ গ্রাম ১১ টাকা।
আলুভাজার জন্য আনুমানিক আলু লাগবে ২৫০ গ্রাম। যার মূল্য প্রায় ৮ টাকা। পেঁয়াজ ১৫০ গ্রাম ৪ টাকা ৫০ পয়সা। মরিচ আর হলুদ গুঁড়া মিলিয়ে ১০ টাকা। লবন ১০/১৫ গ্রাম ২/৩ টাকা। তেল ৫০ গ্রাম ১১ টাকা। জ্বালানি খরচ বাবদ ৫০ টাকা।
তাহলে হিসেব মতে ৫ সদস্যের পরিবারে ডালভাত আর আলুভাজা দিয়ে রাতের খাবার বাবদ খরচ দাঁড়ায় (৭৫+১২+৩+৮+৩+১০+১১+৮+৪.৫+১০+৩+১১+৫০)= ২০৮.৫ টাকা। তার মানে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে হলে ১৪৭ টাকা আর ডাল, আলুভাজা দিয়ে ভাত খেতে হলে ২০৮.৫ টাকা খরচ হয়। এটা কিন্তু একবেলার হিসেব। সে বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।
আরেকটা কথা বলে নেওয়া ভাল। চা শ্রমিকরা কিন্তু আমার আপনার পরিবারের মত বাজারে গিয়ে সারা মাসের বাজার করে নিয়ে আসতে পারে না। সেটা তাদের জন্য স্বপ্ন, দুঃসাধ্য বটে।
চা শ্রমিকরা চা বাগানের কলোনিতে থাকা দোকান থেকে সকালের নাস্তার জন্য ১০ টাকার চিড়ামুড়ি, ৫ টাকার চিনি, রাতের খাবারের জন্য ১ কেজি/ ১.৫ কেজি চাল, ১০ টাকার পাম ওয়েল, ১০ টাকার মশলা, ৫ টাকার পেঁয়াজ, ১০ টাকার আলু, ১০ টাকার ডাল, ৫ টাকার লবন ক্রয় করে থাকেন।
চা বাগানের কলোনির দোকানদারের সাথে কথা বলে জানা গেল, একজন চা শ্রমিক বর্তমান বাজার মূল্যে বাগানের কলোনির ওইসব দোকান থেকে রাতের রান্নার জন্য ৫০ টাকা দিয়ে ১ কেজি সমপরিমান চাল, ১০ টাকা দিয়ে ৫০ গ্রাম সমপরিমান পাম ওয়েল, ১০ টাকা দিয়ে ৫০ গ্রাম করে দুই জাতের মশলা। যার মধ্যে শুধু মরিচ আর হলুদ বরাদ্দ থাকে। ৫ টাকা দিয়ে ৩/৪ টি পেঁয়াজ, ৫ টাকা দিয়ে ২/৩ টি রসুন, ১০ টাকা দিয়ে ৩/৪ টি আলু, ১০ টাকা দিয়ে ১০০ গ্রাম সমপরিমাণ ডাল এবং সকালের নাস্তার জন্য ১০ টাকা দিয়ে চিড়ামুড়ি আর ৫ টাকা দিয়ে চিনি ক্রয় করে থাকেন। সম্ভব হলে নগদ টাকা দিয়ে না হয় বাকিতে এসব প্রয়োজনীয় খরচ এনে কোনমতে খেয়ে একবেলা অতিবাহিত করে থাকেন।
চা বাগানের দোকানগুলো থেকে কিন্তু বাজার মূল্যের চাইতে আরো চড়া মূল্যে চা শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী বাকিতে ক্রয় করে থাকেন। সপ্তাহে তলব (বেতন) পেয়ে দোকানদারের পাওনা মিটান। যেদিন তলব (বেতন) পান সেদিন চেষ্টা করেন বাজার থেকে সস্তা দামের মাছটি কিনে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের রান্না করে খাওয়ানোর। এতেই যেন পরিবারের রোজগার করা মানুষটির মনের শান্তি, তৃপ্তি।
এটা বলে শেষ করতে চাই যে, বাজার থেকে ৩২০/৩৫০ টাকা কেজি দরে ভাল মানের প্যাকেটজাত চা পাতা কিনে এনে এসি রুমে বসে নিজেদের সতেজ করতে যে চা পান করছি, সেই চায়ের পেছনের গল্পের প্রধান চরিত্র কিন্তু এই চা শ্রমিকরা। যাদের শ্রমের নগদ মূল্য এখনও ১২০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সময়ের প্রয়োজনে সেই সব চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিটি কতটা যৌক্তিক সেটা বিচারের দায়ভারটা না হয় সবার উপর ছেড়ে দেওয়া গেলো।
জীবন পাল, সংবাদকর্মী, সিলেট। Email:mrpaul.info@gmail.com