আর মাত্র দু’দিন পরই আসছে ফাল্গুন মাস। এরই মধ্যে ফাগুনের মাতাল হাওয়া বইতে শুরু করেছে প্রকৃতিতে। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। এটি বছরের শেষ ঋতু। দখিনা ঝিরিঝিরি বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত। শীতের নির্জীব প্রকৃতি যেন সহসা জেগে ওঠে।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষগুলো এত দিন যেন বিগত যৌবনা বৃদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে ছিল রিক্ত বেশে। বসন্ত এসে তাকে দান করে যৌবনের উন্মাদনা। মৃতপ্রায় নগ্ন ডালগুলোতে আসে নতুন পাতা। শুকনো মাটির বুক ফেটে গজিয়ে ওঠে মসৃণ সুন্দর ঘাস। বসন্ত আসে পাখির কলকাকলী আর অপার সবুজের সমাহার নিয়ে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি এ সময় নবরূপে সজ্জিত হয়। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা আর পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেতে সবুজের ঢেউ খেলে। পাতায় পাতায় আলোর নাচন। প্রকৃতি ভরে উঠে এক অনুপম সৌন্দর্যে। রং-বেরঙের ফুলে ফলে ভরে যায় গাছগাছালি।
এ ঋতুতে ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুতানে আর পাপিয়ার পিউ পিউ ডাকে চারদিক মুখরিত হয়। সাজ সাজ রব পড়ে যায় প্রকৃতিতে। শেষ বিকালের গোলাপি আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই দূর আকাশে চোখ মেলে সন্ধ্যাতারা। রাত নামে। আকাশে তখন লক্ষ তারার মেলা। তাই দেখে জোনাকিরাও বুঝি তারা হতে চায়। আশ্চর্য সুন্দর বসন্ত রাতের দৃশ্য শুধু চোখই জুড়ায় না, মনও কাড়ে। প্রকৃতি যেন নববধূর সাজে সজ্জিত হয়।
শীতে ম্রিয়মাণ প্রকৃতি বসন্তের জাদুময়ী স্পর্শে হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলিত হয় এবং মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। মৌমাছিরা সারাক্ষণ মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। ফুলের বনে অলিরা গুণগুণ করে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখরিত হয়। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় মনের সুখে। তবে বসন্ত যতটা শোভাময়, ততটা ফলবন্ত নয়। গ্রীষ্মকালে ফলের যে প্রাচুর্য থাকে তার প্রস্তুতি পাঠ এই বসন্তকালে। এ সময়কার ফলের মধ্যে ফুটি, তরমুজ, খরমুজ, ডাব, বাঙ্গি ইত্যাদি প্রধান। প্রকৃতির বুকে বসন্ত আসে ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে। বসন্তের অপূর্ব ফুলসম্ভার বাংলাদেশের চিরশ্যামল প্রকৃতিকে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে ঝলমল করে তুলে। বসন্তের আগমনে পল্লবিত হয় তরুলতা। গাছে গাছে ফোটে বিচিত্র ফুল। গোলাপ, শিমুল, অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি দৃষ্টিনন্দন রক্তিম ফুলগুলো প্রাণে আনন্দের রং ছড়ায়। গায়কপাখি কোকিলকে বলা হয় বসন্তদূত। বর্ষার অভিশাপে যে কোকিল এক দিন বাকরুদ্ধ হয়েছিল, সে ফিরে পায় তার কণ্ঠ। নবপল্লবিত কচি অশ্বত্থ শাখায় বসে ডেকে ওঠে কুহু কুহু। বসন্ত বাউরি ‘বউ কথা কও’ বলে থেকে থেকে ডাক দেয়। চারদিকে বসন্তের জয়ধ্বনি বেজে ওঠে।
বসন্ত সবদিক থেকে জনজীবনের জন্য নিরাপদ সময়। এ সময় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো যায়। লেপ-কাঁথা ছাড়া শোয়া যায় যেখানে খুশি সেখানে। প্রকৃতির কাছে এ নিরাপত্তা পেয়ে মানুষ বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় ধর্মসভা। বিবাহ অনুষ্ঠান ও বউভাতের আয়োজন হয় শহর-গ্রামে সর্বত্র। বছরের সব মেলামোদিনী গান সার্কাসের আয়োজন হয় এ ঋতুতেই। উন্মুক্ত আকাশের নিচে পসরা সাজিয়ে বসে কত দোকানপাট।
বসন্তের স্থায়িত্বকাল খুবই কম। ফাল্গুন-চৈত্র মাসকে তার স্থায়িত্বকাল ধরা হলেও ফাল্গুনের মাঝামাঝি গ্রীষ্মকাল এসে পড়ে। আমাদের দেশে বনভূমি কমে যাওয়ায় শুধু বন্যপ্রাণী নয়, আবহাওয়ায়ও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। শীত ও বর্ষা কমে গিয়ে গ্রীষ্মের দাপট বেড়ে গেছে। শুধু দাপট নয়, গ্রীষ্ম ঋতু বসন্তকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। তাই তখন আমরা ঘাম মুছতে মুছতে ও পাখার বাতাস নিতে নিতে প্রাণান্ত হই।
জীবজগতে বসন্তকাল বৃহৎ বৃহৎ কল্পনা ও স্বপ্নের জন্ম দেয়। জীবনকে রঙিন ও মধুর করে ভাবতে শিখায়। এ মুহূর্তে মানব মনে জাগে কত কথা, কত গান— ‘আজি এ বসন্ত সমীরণে/কত কথা মোর মনে পড়ে।’ দখিনা বাতাসের মৃদুদোলা দেহ ও মনের ক্লান্তি জুড়ায়। বসন্তের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আমাদের প্রাণকে চঞ্চল করে তোলে। নবজাগরণের দোলা লেগে এ সময় বাংলার প্রকৃতি যেমন শিহরিত হয়; তেমনি অজানা এক সুরের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাঙালির হৃদয়। দখিনা হাওয়া পথিকের হৃদয়ে উদাসীনতার সুর তোলে। হৃদয় পাগল করা বাংলার এ রূপ শুধুই বাংলার।
বসন্ত প্রকৃতিতে ফুল ফোটায়, পত্রঝরা বৃক্ষে নবপল্লবের আশীর্বাদ বয়ে আনে, শুষ্ক মৃত্তিকাতে জাগায় কচি কিশলয়। শীতের অসুস্থ প্রকৃতিকে সে দান করে সুস্থতা, তৃণপল্লবও পত্রপুঞ্জে সমৃদ্ধ করে প্রকৃতিকে। কিন্তু আমাদের জন্য বসন্ত কি দেবে? বসন্ত আমাদেরকে দেবে ব্যক্তিত্ব, সুস্থ করে তুলবে চিন্তার অসুস্থতা। অলসতা, অকর্মণ্যতা, নৈতিক অধঃপতন আমাদের চিন্তার অসুখ। এগুলোই আমাদের জীবনের জীর্ণতা, পঙ্গুতা ও আড়ষ্টতা। আমরা সেদিনের জন্যই অপেক্ষা করব, যেদিন প্রকৃতির বসন্তের সঙ্গে আমাদের জীবনেও বসন্তের আগমন ঘটবে। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও অসততা হতে যেদিন আমরা মুক্ত হতে পারব; সেদিনই আমাদের জীবন ফুলের পাপড়ির মতো শোভা ও সৌন্দর্যে ভরে উঠবে। আর সেদিনই সূচিত হবে আমাদের জীবনের বসন্ত। প্রকৃতিতে নিরন্তর বসন্তের সুবাতাস প্রবাহিত হোক।