আর্জেন্টাইন গণমাধ্যমে মেসির বাংলাদেশি সমর্থকরা

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছে মেসির আর্জেন্টিনা। রোববার (১৮ ডিসেম্বর) ফ্রান্সের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়ের মাধ্যমে ৩৬ বছর পর আবারও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব পেল দক্ষিণ আমেরিকান এই দেশটি।

আলবিসেলেস্তেদের এই বিশ্বজয়ের আনন্দ ছুঁয়েছে সারা বিশ্বকেই। তবে মেসিদের এই সাফল্য ব্যাপক ভাবে ছুঁয়ে গেছে আর্জেন্টিনা থেকে অর্ধ পৃথিবী দূরে অবস্থিত বাংলাদেশেও। বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করতে বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তদের ‘মেসি, মেসি’ বলে স্লোগান এবং রাস্তায় আনন্দের অশ্রু ঝরিয়ে নাচের খবর ছড়িয়ে পড়েছে আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমেও।

ফ্রান্সের বিপক্ষে রোববারের নাটকীয় বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধে ২-০ তে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে দুই মিনিটে দুটি গোল হজম করে। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে মেসি গোল করলেও পরে পেনাল্টি কিক দিয়ে স্কোরে আবারও সমতা ফেরান এমবাপে।

শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুটআউটে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। আর এর মাধ্যমে ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালের পর তৃতীয়বার বিশ্বকাপ ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা।

রোববারের ফাইনালে আর্জেন্টিনার হয়ে দু’টি গোল করেন ৩৫ বছর বয়সী মেসি, অপরটি করেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। অন্যদিকে ২৩ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে এদিন ফ্রান্সের একমাত্র স্কোরার হিসেবে তিনটি গোল করেন।

বাংলাদেশের মেসি ভক্তদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা নিয়ে সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) সংবাদ প্রকাশ করেছে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম বুয়েনস আইরেস টাইমস।

বার্তাসংস্থা এএফপির বরাতে প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়েছে, রোববার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয় উদযাপনে মাতেন দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি থেকে অর্ধ পৃথিবী দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের সমর্থকরা।

এসময় মেসির বিশ্বজয়ের আনন্দে শীতের মধ্যেও বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা ‘মেসি, মেসি’ বলে স্লোগান দেন এবং রাস্তায় আনন্দের অশ্রু ঝরিয়ে নাচতে থাকেন।

পুলিশের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নানা চত্বর, রাস্তা এবং ফুটবল মাঠে স্থাপন করা বিশালাকার পর্দায় ফাইনাল ম্যাচটি দেখতে কয়েক হাজার মানুষ ঠান্ডা তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করেই জড়ো হয়েছিলেন।

এসব ফুটবল ভক্তদের অনেকেই আর্জেন্টিনার আইকনিক নীল-সাদা জার্সি এবং লিওনেল মেসির আইকনিক ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলা দেখায় অংশ নেন। ১৮ বছর বয়সী মেসিভক্ত নাফিউন রহমান জিয়ান এএফপিকে বলেছেন, ‘আমি জানি না কেন আমি কাঁদছি, তবে আমি তার (মেসি) জন্য কাঁদছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের অপেক্ষার বছরের পর বছর (শেষ হয়েছে)। ফুটবলের ছোট্ট জাদুকর, সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ট্রফিটি হাতে পেয়েছেন যা তিনি খুব চেয়েছিলেন।’

১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং দেশটির অধিকাংশ মানুষ ক্রিকেট পাগল। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় দল বিশ্বের অন্যতম সেরা। তবে বিশ্ব ফুটবলে তলানিতে রয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু প্রতি চার বছর পর পর বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের তরুণ-যুবকসহ বেশিরভাগ মানুষ খেলাধুলার সঙ্গে নিজেদের প্রেমের সম্পর্ককে নতুন করে ফুটিয়ে তোলেন। এসময় অনেক তরুণ নিজেদের দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিভক্ত করে– যাদের একটি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে, অন্যটি ব্রাজিল।

রোববারের ফাইনাল ম্যাচ বড় পর্দায় দেখতে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হয়েছিল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এসময় অনেকে প্রিয় দলের খেলা দেখতে তাদের গালে আর্জেন্টিনার পতাকা এঁকেছিলেন।

খেলার প্রথমার্ধে পেনাল্টি থেকে মেসি প্রথম গোলটি করলে দর্শকরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। পরে আর্জেন্টিনার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার দেওয়া গোলে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর চোখ মুছতে মুছতে ইমন গাজী নামের এক ভক্ত বলেন, ‘আমি কতটা খুশি তা প্রকাশ করতে পারব না।’

১৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু, বিশেষ করে যারা ব্রাজিলকে সমর্থন করে, তারা আমাকে এবং আর্জেন্টিনার অন্য সমর্থকদের কটূক্তি করে বলত- ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে আমরা কিছুই জিততে পারিনি, যখন আমি জন্মগ্রহণও করিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেসি প্রমাণ করেছেন তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। তিনি ডিয়াগো ম্যারাডোনা বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চেয়েও বড়। (বিশ্বকাপ জেতায়) বিতর্ক এখন শেষ হয়েছে।’

বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ বেড়েছে এবং গ্রামীণ শহরগুলোতে সমর্থকরা তাদের বাড়ি নিজ নিজ দলের রঙে আগেই রাঙিয়েছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বাড়ির ওপর পছন্দের দলের জাতীয় পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং ছাদ থেকে পড়ে অন্তত সাতজন লোক মারা গেছেন।

এছাড়া গ্রামীণ শহরগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত তিনজন মারা গেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মাতামাতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ব্রাজিল-আর্জন্টিনা নিয়ে বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, বিশাল বিশাল পতাকা টাঙানো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে বাড়ির বারান্দা, সেতু রাঙানোর বিষয়ও তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ৯ হাজার ৫০৩ মাইল। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের দূরত্ব ১০ হাজার ৪২০ মাইল। তা সত্ত্বেও এ দুই দেশ নিয়ে বাংলাদেশে মাতামাতি ব্যাপক।

যেসব বাংলাদেশি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতামাতি করেন তাদের সঙ্গে কখনও কোনও ব্রাজিলিয়ান বা আর্জেন্টাইনের দেখা হবে না— তা সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা এ দুই দেশ নিয়ে উন্মাদনায় মাতেন।