বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য, কোরবানির ঈদের আগে ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি। সম্প্রতি ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরার ঢাকা সফরে এসব বিষয় আলোচনায় আসে।
সারা বছরের গরুর চাহিদার বড় অংশ থাকে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে বছরের প্রায় অর্ধেক গরু জবাই হয়। কয়েক বছর আগেও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গরু আমদানি হতো, কিন্তু দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি এখন বন্ধ।
ঢাকার বাজারে গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজি ৮০০ টাকায় উঠেছে। দেশে গরুর মাংসের চড়া দামের কারণে ভোক্তা সাধারণ এমনকি ব্যবসায়ীদের একাংশ সময়-সময় গরু ও মাংস আমদানি নিয়ে কথা বলেছেন। তবে আমদানির বিষয়ে খামারিদের পক্ষ থেকে আপত্তি আছে। এমন উদ্যোগ স্থানীয় শিল্পের জন্য সুখকর হবে না বলে মনে করেন খামারিরা; বরং মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য গোখাদ্যের দামে লাগাম টানার কথা বলছেন তাঁরা। একই সঙ্গে এই শিল্পকে টেকসই করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন করেছেন তাঁরা।
দেশে গরু ও মাংস আমদানির বিষয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান গরুর মাংসের দাম বিবেচনায় নিলে সরকার গরু আমদানির পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে দেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম কমানো সম্ভব হবে। সরাসরি মাংস আমদানির বেলায় সংবেদনশীল অনেক বিষয় আছে, সেগুলো আমলে নিতে হবে, তা না হলে বাজারে আরেকটা গোলযোগ তৈরি হতে পারে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
তবে গরু কিংবা মাংস আমদানির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। খামারিদের এই সংগঠন বলছে, দেশে গরুর সংকট নেই। সরকারি তথ্য-উপাত্ত থেকেও একই বিষয় জানা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমদানির বিষয়টি যদি গরুর দামকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে, তাহলে সরকার স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় বিকল্প চিন্তা করতে পারে।
বিডিএফএর সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের বাড়তি দাম ও মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে দেশের বাজারে গত তিন বছরে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে তিন গুণ। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। খাদ্যের দাম কমালে উৎপাদন খরচ কমবে, স্বাভাবিকভাবে মাংসের দাম কমে আসবে। দেশে পর্যাপ্ত গরুর উৎপাদন আছে। সুতরাং তেমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার বিষয়টি আগে ভাবতে হবে। এখানে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এসেছে। সরকারের উচিত, এই শিল্প কীভাবে আরও টেকসই হয়, তা ভাবা।
খামারিদের একাংশের দাবি, খামার থেকে কম দামে গরু কিনে বাজারে বাড়তি দামে মাংস বিক্রি করে একশ্রেণির মাংস ব্যবসায়ী। ঢাকার বাজারে মাংস ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে বলেও দাবি অনেকের। খলিল, উজ্জ্বল ও নয়নের মতো কিছু ব্যবসায়ী ঢাকায় কিছুটা কম দামে মাংস বিক্রি করে আলোচনায় আসে। অনেকের ধারণা, তাঁরা পারলে অন্যরা কেন কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারছেন না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা বলেন, যেসব ব্যবসায়ী কম দামে মাংস বিক্রি করেছেন, সেই মাংসের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার অনেকের বেচাবিক্রি বেশি হওয়ার কারণে কিছুটা কম রাখতে পারেন।
রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরের আলোচিত মাংস ব্যবসায়ী খলিলুর রহমানও সম্প্রতি মাংসের দাম কিছুটা বাড়িয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, সরকার ভারত থেকে গরু আমদানির অনুমতি দেবে; কিন্তু সেটা না হওয়ায় মাংসের দাম বাড়াতে হয়েছে। কারণ, খামার থেকে গরু কিনতে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে।
গরুর মাংসের বাজার যত বড়
সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে গরুর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি ৪৯ লাখ, ২০১৩-১৪ সালে যা ছিল ২ কোটি ৩৫ লাখ। সেই হিসাবে গত ১০ বছরে দেশে গরুর সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৪ লাখ। সরকারের এই হিসাবে প্রতিবছরই গরুর সংখ্যা কিছু না কিছু বাড়তে দেখা গেছে। যদিও সামগ্রিকভাবে গত অর্থবছরে ৯ বছর পর মাংসের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ লাখ ৫৫ হাজার টন কম মাংস উৎপাদিত হয়েছে। সেবার উৎপাদন হয়েছে ৮৭ লাখ ১০ হাজার টন।
এদিকে গত ১০ বছরে দেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম দেড় গুণ বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল গড়ে ৩০০ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল মঙ্গলবারের হিসাব, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায়। অর্থাৎ ২০১৪ সালের তুলনায় এখন গরুর মাংসের দাম এখন ১৫০ শতাংশের বেশি।