আদালতে মামলা চলমান থাকা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণগ্রহীতার এলাকায় গিয়ে মাইকিং করেছেন এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তারা। এমনকি ওই গ্রাহকের বাড়ির সামনে অবস্থা্ন করে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তারা।
গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে সিলেট নগরীর মজুমদারী এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার একটি ভিডিও একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করা হয়েছে। এতে কেউ কেউ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানালেও অনেকে এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন।
আইনজীবিরাও বলছেন, বিষয়টি সম্পুর্ণভাবে বেআইনি। মামলা চলমান থাকাবস্থায় ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে গিয়ে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা অর্থঋণ আদালত আইনে কোনো বিধান নেই। অতি উৎসাহী হয়ে এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও যোগসাজেশ থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
নগরীর জিন্দাবাজারস্থ এক্সিম ব্যাংকের সিলেট শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সিলেট নগরীর মজুমদারী এলাকার ১৩১ মজুমদার বাড়ির বাসিন্দা মকসুদ আহমদ চৌধুরী তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মকসুদ আহমদ নামে ওই শাখা থেকে ৭ কোটি টাকা সিসি ঋণ নেন। পরবর্তীতে ঋণের টাকা কয়েক দফায় ফেরত দেন। আবার নতুন করে ঋণও নেন। সব মিলিয়ে কয়েক দফায় তিনি ব্যাংক থেকে ১১কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। আবার পরিশোধও করেছেন। বর্তমানে সুদসহ ঋণের পরিমাণ ১৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত মকসুদ আহমদ ব্যাংকে ঋণের টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু ঋণের পরিমাণ বড় হওয়ায় ব্যাংকের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হয়। পরে ২০২৩ সালে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমি বিক্রি করে ২ কোটি টাকা ফেরত নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঋণের সমপরিমাণ জমির দাম না হওয়ায় ২০২৩ সালের ৬ জুন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। সেই মামলা এখনও চলমান।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে খেলাপি ঋণ আদায়ে এক্সিম ব্যাংকের সিলেটের কয়েকটি শাখার ম্যানেজার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মকসুদ আহমদ চৌধুরীর বাসার সামনে গিয়ে ব্যানার টানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে তারা পুরো এলাকায় ঘুরে মকসুদ আহমদকে ঋণ খেলাপির কারণে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানান।
একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করা ভিডিওতে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, মকসুদ আহমদ চৌধুরী তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে এক্সিম ব্যাংক সিলেটের জিন্দাবাজার শাখা থেকে বিনিয়োগের নামে ঋণ নেন। বর্তমানে ১৯ কোটি ঋণ নেন। বিলাসী জীবনযাপনকারী মকসুদ আহমদ গত ১৬ বছরে একটি টাকাও ফেরত দেননি। ঋণের টাকা পরিশোধ না করে টানবাহানা করে ১৬ বছর কাটিয়ে দেন। বিগত বছরগুলোতে তাকে নোটিশের পর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ব্যাংকের লোকজন প্রতিনিয়ত তার বাসায় আসলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাহকের বাসার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা আরও বলেন, এসব গ্রাহকের জন্যই রাষ্ট্রর অর্থনীতি, ব্যাংক ও দেশ নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টর টালমাটাল হয়েছে। এখন আমরা টাকা চাচ্ছি, যতক্ষণ টাকা পাবো না, ততক্ষণ এখানে অবস্থান করবো।
আরেক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকের নিজস্ব কোনো টাকা নেই, জনগণের টাকা থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু ঋণ গ্রহিতা মকসুদ আহমদ চৌধুরী আয়েশী জীবনযাপন করা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। যে কারণে আমরা গ্রাহকদের টাকা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য ঋণ ফেরত দিতে সচেতন নাগরিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এছাড়াও এরকম লোককে খেলাপি ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি ও সামাজিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানান তারা।
জানা গেছে, মকসুদ আহমদ চৌধুরী পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঠিকাদার। এ ঘটনার পর তার বক্তব্য নিতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্ঠা করেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মাসুম ইয়াসিন বলেন, ‘ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে ঋণ গ্রহীতার বিাড়িতে গিয়ে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এটা এই প্রথম কোনো ঘটনা না। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ আদায়ে এরকম কর্মসূচি পালন করেছে।’
আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় এরকম কর্মকাণ্ড কতটুকু যৌক্তিক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মামলা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মামলা দিলেই সহজে টাকা আদায় করা যায় না। মামলা মামলার মতো চলছে। আমরা টাকা আদায় করতে এই উদ্যোগ নিয়েছি।’
মাসুম ইয়াসিন আরও বলেন, ‘২০০৯ সালে তিনি এক বছর মেয়াদে প্রায় ৭কোটি টাকা সিসি ঋণ নিয়েছেন। এরপরে তিনি কয়েক দফায় টাকা দিয়েছেন। আরও ঋণও নিয়েছেন। তিনি প্রায় ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। গত বছর ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমি বিক্রি করে ২ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু তার জমির দামের তুলনায় ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তাই টাকা উদ্ধারে এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।’
তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এই কর্মকাণ্ড বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনী বলে জানিয়েছেন আইনজীবিরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের একজন সিনিয়র আইনজীবি বলেন, ‘আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই করা যায় না। আদালতের রায় হলে তাকে ঋণ খেলাপির অভিযোগে অভিযুক্ত করা বলা যায়। কিন্তু ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে গিয়ে এমন কর্মকাণ্ড কোনো আইনে নেই। এই কাজটি সম্পূর্ণ বেআইনি।
এ বিষয়ে সিলেট আদালতের অ্যাডভোকেট আশফাকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এমন অপেশাদার কর্মকাণ্ড অর্থঋণ আদালত আইনসহ প্রচলিত কোন আইন সমর্থন করে না। কেউ আদৌ ঋণ খেলাপী কী না, তা মোকদ্দমা দায়েরের পর তা আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেবেন।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের এমন আইন বহির্ভূত উদ্ভট কর্মকান্ড ব্যাংকারদের আইনের অজ্ঞতা ও বিবেকবুদ্ধির ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ। স্পষ্টত এমন কান্ডে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাক্তির ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।’