ভয়ে প্রতিটি ওষুধের ছবি তুলে রাখতাম, যদি মারা যাই…

রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জহুর আলী

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর নির্মম নির্যাতনের খবর দেখে নিজেও আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে পড়েন ব্যবসায়ী জহুর আলী। কিন্তু পুলিশের গুলির ভয়ে স্ত্রী ও বড় ভাই তাঁকে আন্দোলনে যেতে বাঁধা দেন। তবুও সকল বাঁধা উপক্ষো করে ৪ আগস্ট দুপুরে লুকিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলন যোগ দেন জহুর আলী।

কিন্তু ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়’ প্রবাদটিই লেখা ছিল জহুর আলীর ভাগ্যে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলন করছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে আটক করেন। দুইজন তার পড়নের শার্ট-গেঞ্জি টেনে হিঁচরে খুলে ফেলেন। অপরজন মাত্র তিন-চার ফুট দুরত্ব থেকে গুলি ছুড়েন জহুর আলীর পা, কোমড় ও হাতে। শটগানের গুলিতে রক্তাক্ত পড়ে যান রাস্তায়। এরপর আর তিনি কিছু বুঝতে পারেননি।

সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন জহুর আলী কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি এভাবেই বর্ণনা করেন। জহুর আলী সুনামগঞ্জ পৌরসভার বাঁধনপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পেশায় তিনি একজন মুদি দোকানী।

কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন আরও ভীতিকর পরিস্থিতির। যে স্মৃতিগুলো জীবনের বাকি সময়ে কোনোদিনও ভুলে যাওয়ার মতো নয় বলেন জহুর আলী।

জহুর আলী বলেন, ‘জ্ঞান ফেরার পর আমি জানতে পারি আমাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ততক্ষণে আমার নাম-পরিচয় ও পেশাসহ সকল তথ্য নিয়ে ফেলেছে সেখানকার পুলিশ সদস্যরা। গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও ঘন্টাখানেক সময় পরে চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা। তাতেও শঙ্কা ছিল। ভয় ছিল যদি চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা যদি আমাকে মেরে ফেলেন। এজন্য প্রতিটি ওষুধের ছবি তুলে রাখতাম। যদি মারা যাই তাহলে অন্তত প্রমাণ থাকবে।’

জহুর আলী বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে আহত হয়ে যারা ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাদের মধ্যে সবসময় একটা আতঙ্ক থাকতো। কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। ভয়-আতঙ্ক নিয়ে ৪ আগস্ট রাত পার হলেও আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় পরদিন ৫ আগস্ট। এদিন বেলা তিনটার দিকে হাসপাতালে খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তখন ভয়টা আরও বেড়ে যায়। কখন কী হয় বুঝতে পারছিলাম না।’

তিনি বলেন, ‘হাসিনার পদত্যাগের পরে সিদ্ধান্ত নিলাম ওসমানী হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাবো। কিন্তু তারা আমাকে ছাড়তে রাজি হয়নি। ভয়টা আরও বেড়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হয়তো আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে। কোনোমতে রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরদিন ৬ আগস্ট সকালে নগরীর রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই।’

কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ জহুর আলী বলেন, ‘রাগীব রাবেয়া হাসপাতালে আসার পরে দৃশ্যপট বদলে যায়। এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোটা আন্দোলনে আহত শুনে আমাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করে। দ্রুত দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচার করে আরু গুলি বের করে। হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-চিকিৎসকরা সার্বক্ষণিক খোঁজবর রাখছেন। এমনকি কোটা আন্দোলনে আহত শুনে সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হচ্ছে।’

জহুর আলীর মতো কোটা আন্দোলনে আহত হয়ে সিলেটের রাগীব রাবেয়া হাসপাতালে অনেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে পুলিশি হয়রানীর ভয়ে আহত অসংখ্য শিক্ষার্থী-জনতা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ৫জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ ও একজনের শরীরে কোপের আঘাত রয়েছে। আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের তৃতীয় তলায় ৩২৪ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সিলেট নগরীর দিশারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন রুহি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আখালিয়া এলাকার সৈয়দ হোসেনের ছেলে রুহি ৫ আগস্ট বিকেলে ‘বিজয় মিছিল’ দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৫-২০টি গুলি ঢুকে স্কুল পড়ুয়া রুহির শরীরে।

১৬ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে রুহিকে। প্রথমদিন চিকিৎসকরা তার শরীর থেকে ৮টি গুলি বের করেন। গত রোববার (১৮ আগস্ট) দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচার করে আরও ৮টি গুলি বের করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন রুহি এখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নয়। তার শরীরে আরও গুলি থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।

ঘটনার বর্ণনায় স্কুলছাত্র রুহি বলেন, ৫ আগস্ট ‘বিজয় মিছিল’ দেখতে বাসার সামনে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই সময় গুলি হবে ভাবছিলাম না। হঠাৎ করে শরীর বিভিন্ন স্থানে আঘাত লাগে। পরে আমাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কোটা আন্দোলনে আহতদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়ে এখানে এসেছেন সবাইকে আলাদাভাবে তত্বাবধান করা হচ্ছে। আহতরা যাতে দ্রুত চিকিৎসা পান সেজন্য আমরা সবসময় যোগাযোগ রাখছি। অস্ত্রোপচারসহ  বিনামূল্যে সকল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি কেউ কেবিনে থাকার ইচ্ছে পোষণ করলেও আমরা তাকে বিনামূল্যে কেবিন বরাদ্দ করেছি।

এ বিষয়ে রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তারেক বলেন, কোটা আন্দোলনে আহত ৫জন বর্তমানে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪জন গুলিবিদ্ধ ও একজনের শরীরে কোপের আঘাত রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও কোটা আন্দোলনে আহত ভর্তি রোগীদের সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে ও দ্রুত সেবা দিতে সকলকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।