বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে ঘৃণিত, বর্বরতম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের একটি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। এটি শুধু হত্যাকাণ্ডই ছিল না; একটি সদ্য স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার নীলনকশা ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দেশ, বিদেশি অপশক্তি এবং ঘাতকচক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করেছিল।
দিনটি বাঙালির জাতীয় শোক দিবস। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে জাতি শোকাতুর হৃদয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনসহ নানা জাতি-গোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতিত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে। পর্বতসম সাহস আর সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম, সর্বোপরি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বের মানুষের কাছে মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়।
স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদিনের শোষিত-বঞ্চিত এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করলে তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হন। এসব ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তারা প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যায়। আবারও বাঙালির ঘাড়ে জেঁকে বসে সামরিক স্বৈরশাসন। দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে। সেইসঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা।
১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে নির্মমভাবে নিহত হোন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ দেশবরেণ্য সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষায় এগিয়ে আসা প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয় ।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সারা বিশ্বে তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে এবং বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশীরা বিশ্বজুড়ে মানুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা হারায়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে, সাহসী বাঙালিরা নিজেদেরকে একটি কাপুরুষ-আত্মঘাতী জাতি হিসেবে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়।
বাঙালি জাতির চেতনা, স্বপ্ন, ইতিহাস, সংগ্রাম এবং সাফল্যের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের এই মহানায়ক চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।