সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাঁর নামে ২৪০ বিঘা জমি। রাতারাতি গৃহিণী থেকে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া জীশান মীর্জার সম্পদের পরিমাণ স্বামীর চেয়ে প্রায় ১৩ গুণ বেশি। খবর কালেরকণ্ঠ।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। এ আদেশে জীশান মীর্জার নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের সাতটি হিসাব এবং শেয়ারবাজারে দুটি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেন আদালত।
আদালতের আদেশের নথিতে দেখা যায়, জীশান মীর্জার নামে ৫৭টি দলিলে রয়েছে ২৪০ বিঘা জমি। এই জমি কিনতে দলিল মূল্যে জীশান মীর্জার ব্যয় হয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে তাঁর একক নামে পাঁচটি দলিলে জমি কিনেছেন ৭৮৮.৪৫ শতাংশ বা ২৩.৮৯ বিঘা। যার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। তবে বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী এসব জমির মূল্য অন্তত পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি বলে জানা গেছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ এবং অবরুদ্ধ করতে আদালতে আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ৮৩টি দলিলের অনুকূলে ৩৪৬.৩০ বিঘা জমি জব্দ করার আদেশ দেন আদালত। দলিল মূল্যে যার দাম দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
পাশাপাশি তাঁদের নামে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব, চারটি ক্রেডিট কার্ড, ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। অর্থপাচার আইন ২০১২-এর ১৪ ধারা এবং দুদক বিধিমালা ২০০৭-এর বিধি ১৮ অনুযায়ী সকল স্থাবর সম্পদ জব্দ এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধের এ আদেশ দেন আদালত।
নথি পর্যালোচনায় জানা যায়, বেনজীর আহমেদ তাঁর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্ত্রী জীশান মীর্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, মেজো মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, কক্সবাজারের বিভিন্ন মৌজায় থাকা জমি জব্দ করা হয়েছে, যা দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। বেনজীর আহমেদের এই সম্পদ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন দুদকের কর্মকর্তারা।
নথিতে দেখা যায়, গোপালগঞ্জ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অধীনে হওয়া ৬৫টি দলিলের জমি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শুধু গোপালগঞ্জ সদরে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৩০২.৫৮ বিঘা জমি রয়েছে, যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের আওতায় রেজিস্ট্রি করা তিনটি ও কোটালীপাড়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের আওতায় থাকা ছয় দলিলের সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বেনজীর ও তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৯টি দলিলের জমি জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের আদেশে গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, উখিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সাবরেজিস্ট্রারকে জব্দ করা এসব সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তথ্য পর্যালোচনায় আরো দেখা যায়, বেনজীর আহমেদের নামে ১৫ দলিলে ২৭ বিঘা জমির দলিল মূল্য প্রায় এক কোটি ৭১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। ২৭ বিঘা বা ৯২০.০৩ শতাংশ জমির মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামে গোপালগঞ্জ সদর রেজিস্ট্রি অফিসে ১০টি দলিলে ৭৪৫.০৩ শতাংশ বা ২২.৫৭ বিঘা জমি রয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের বিভিন্ন ভূমি অফিসে পাঁচটি দলিলে ১৭৫ শতাংশ বা ৪.৭৫ বিঘা জমি রয়েছে, যার দলিল মূল্য উল্লেখ্য করা হয়েছে ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
সাভানা ফার্ম প্রডাক্টের পক্ষে চেয়ারম্যান জীশান মীর্জা ২৩টি দলিলে গোপালগঞ্জ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের আওতায় ৮৫ বিঘা জমি ক্রয় করেন। যার দলিল মূল্য উল্লেখ্য করা হয়েছে দুই কোটি ৫০ লাখ ১৭ হাজার টাকা। সাভানা পার্ক রিসোর্ট অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাবের পক্ষে জীশান মীর্জা ১৩টি দলিলে ৩৪.৩১ বিঘা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা অ্যাগ্রো ও সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভের নামে যথাক্রমে ১২.২৭ বিঘা, ৬০.৯৯ বিঘা ও ২২.৯১ বিঘা জমি কিনেছেন, যা আদালত জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নথি পর্যালোচনা করে আরো দেখা যায়, বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের নামে গোপালগঞ্জ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৪২.১৬ বিঘা জমি রয়েছে, যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। গোপালগঞ্জের সাহপুর ইউনিয়নের টুঢামান্দ্রা মৌজার জমিটির এসএ খতিয়ান নম্বর ৭৭৫, ৭৭৬, ৭১০, ৭১৮, ৭১৯, ৭৭৭, ৭৭৮, ৭৭৯, ৭৮০ ও ৭৮১। এ ছাড়া তিন মেয়ে ও আবু সাইদ মো. খালেদ ও আরু রুহ মিজান স্নেহার নামে বিভিন্ন দাগে ১০টি দলিলে ৩৬.৬৮ বিঘা জমি কিনেছেন বেনজীর আহমেদ, যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৮৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৩টি ব্যাংক হিসাব, চারটি ক্রেডিট কার্ড ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্টসহ মোটি ৩৩টি অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামে আটটি, স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে সাতটি, মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে চারটি, ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের নামে দুটি ব্যাংক আ্যাাকাউন্ট রয়েছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দুটি ব্যাংক হিসাব, চারটি ক্রেডিট কার্ড ও দুটি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশের করপোরেট শাখার একটি ও প্রাইম ব্যাংক মহাখালী শাখার একটি হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সিটি ব্যাংকের প্রধান শাখার চারটি ক্রেডিট কার্ড ও আইএফআইসি সিকিউরিটিজ ও ড্রাগন সিকিউরিটিজের দুটি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে স্ত্রী জীশান মীর্জার সাতটি ব্যাংক হিসাব ও দুটি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটি ব্যাংকের প্রধান শাখার একটি, আইএফআইসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার দুটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের বংশাল শাখার দুটি, এবি ব্যাংকের প্রধান শাখার একটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের উত্তরা শাখার একটি অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস, ইবিএল সিকিউরিটিজে থাকা জীশান মীর্জার দুটি বিও হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বেনজীরের স্ত্রী ও মেয়েদের নামে থাকা ছয়টি কম্পানির পৃথক ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের তিনটি চলতি হিসাব ও একটি ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
আদালতের আদেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের কেউ অ্যাকাউন্টগুলো থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়।