সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ছয়টি উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া। দেশে চিনিরদাম বৃদ্ধির ফলে ইদানিং সেসব সীমান্ত দিয়ে চোরাকারিবারিরা ভারত থেকে অবৈধ ভাবে চিনি নিয়ে আসছে বাংলাদেশে।
রাতের বেলা চিনি পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিপুর উপজেলার সীমান্ত। ঘড়ির কাটা যখন রাত ১২টা পার হয়, তখনই শুরু হয় ট্রাক ভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চিনি পাচার। বর্তমানে এ ব্যাপারটি একরকমন “ওপেনসিক্রেট”।
চোরাকারবারিদের সহযোগিতা করার অভিযোগ খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। যারা এই অবৈধ কাজ বন্ধ করার কথা তারাই চোরাকরিবারিদের সাথে মিলে করছেন ব্যবসা। প্রতিদিন রাত ১২ টার পর প্রায় ৫০ কেজির কয়েক হাজার বস্তা চিনি বের হয় সড়ক দিয়ে। শহরের সাথে সংযোগ স্থল আব্দুজ জহুর সেতু দিয়ে একযোগে সারি সারি ত্রিপলে মোড়ানো ছোট-বড় ট্রাক দিয়ে পাচার হয় চিনি। পুলিশ দেখেও দেখে না।
গত (৮ডিসেম্ভর) শুক্রবার রাত ১টার দিকে স্থানীয়দের সংবাদের ভিত্তিতে সদর থানা পুলিশ একটি ট্রাক থেকে ২৯৮ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করে। কিন্ত ঐ স্থানে টহলরত পুলিশকে পায় নি স্থানীয়রা।
সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সুনামগঞ্জের সদর উপজেলা ও বিম্বম্ভপুর উপজেলার সীমান্তদিয়ে প্রতিদিন আসছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ভারতীয় চিনি। এ কারণে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি এই সব এলাকায় দিন দিন বাড়ছে চোরাচালানিদের দৌরাত্ম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় বৈঠাখালী এলাকার সুরমা নদীর উপর আব্দুজ জহুর সেতু নির্মাণের পর বদলে যায় এই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা। সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ার ফলে গাড়ি বা মটর সাইকেলে করে দ্রুতই চলে আসা যায় সুনামগঞ্জ শহরের বা সিলেটে। এই সেতুটিই মূলত চোরাচালানের মূল প্রবেশ পথ হিসেবে কাজ করে। রাত ১২ টার পর থেকে বদলে যায় সেতু এলাকার চিত্র। নিরবতা ও লোক সমাগম কমে যাওয়া এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার এই দুইকে পুঁজি করে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ভারতীয় চিনি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সরেজমিন রাত ১২ টার পর আব্দুজ জহুর সেতু থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন্দ পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, শীতের কারণে চারদিকে কুয়াশার চাদরে ডাকা। এরই মধ্যে লাইন ধরে দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট রোডের দিকে ছুটছে ট্রাক। ট্রাকগুলোর দিকে লক্ষ করতেই দেখা গেলো পলিথিনে মুড়ানো ট্রাক ভর্তি ভারতীয় চিনি নিয়ে যাচ্ছে চোরাকারবারিরা। আব্দুজ জহুর সেতু থেকে সামান্য দূরে সদর উপজেলা বৈঠাখালি গ্রামের রাধানগর পয়েন্ট। সেই পয়েন্ট যেতেই অন্ধকারের মধ্যে চোখে পড়ে একটি মাল বোঝাই ট্রাক। সেই ট্রাকের সামনে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে গিয়ে ছবি ধারণ করার জন্য ক্যামেরা চালুকরতেই দেখা যায় পুলিশ সদস্যরা। তারা সেখানে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে ট্রাক রেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
ট্রাক চালক শিবুল জানান, গাড়িতে ভারতীয় চিনি আছে। সেগুলো জেলার জাউয়াবাজার এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে আনলোড হয়ে কই যাবে তা আমি জানি না। পুলিশ ট্রাক আটকে ছিল টাকা নেয়ার জন্য কিন্তু তারা এখানে আপনাদেরকে দেখে পালিয়ে গেছে।
পরে রাধানগরপয়েন্ট থেকে আরও কিছু দূরে চালবন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায় অন্যচিত্র। সেখানে সড়কের দুই পাশে পুলিশের চেক পোস্ট বসানো। কিন্ত সেখানে দায়িত্বরত কোন পুলিশ সদস্যকে পাওয়া যায় নি। চালবন পয়েন্ট থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ বাজারের চা বিক্রেতা করম আলীর সাথে কথা হয়, সে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চায়ের ব্যবসা করে এই বাজারে। প্রতিদিন দুপুর ২ টা থেকে রাত ৪ টা পর্যন্ত বেচা কেনা হয় তার। রাত ১২ টার পরে বেচাকেনা জমে উঠে ঐ চা বিক্রেতার। রাতের ক্রেতা মূলত চোরাকারবারিদের সহযোগী শ্রমিকরা।
করম আলী জানান, শুধু পলাশ বাজার দিয়ে চোরাকারবারিরা ভারতীয় চিনি আনে না, উপজেলার অন্য সড়ক দিয়েও প্রতিদিন ভারতীয় চিনি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বাজারে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে কোটি কোটি টাকার চিনি, আলু, মসলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় অবৈধ পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। তবে চিনিটাই বেশি।
প্রতিদিন রাত ১২ টার পর ধনপুর, চিকারকান্দি, বাঘবেড়, চেংবিল, শরীফগঞ্জ, মতুরকান্দিসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৮ থেকে ১০ টি ট্রাক ভর্তি চিনির গাড়ি বের করে চোরাকারবারিরা। প্রতিটি গাড়িতে প্রায় ৩০০ বস্তা করে ভারতীয় চিনি থাকে বলে জানা যায়।
আর এই চক্রের সাথে কতিপয় কিছু অসাধু পুলিশসহ প্রভাবশালী চক্র রয়েছে। ট্রাক গুলো সদর উপজেলার বৈঠাখালি এলাকার রাধা নগর সড়কে আসলে পুলিশকে নগদ টাকা দিয়ে ট্রাকগুলো ছেড়ে যায়।
অনুসন্ধনে আরও জানা যায়, বিভিন্ন চেক পোস্ট পার হয় ট্রাক গুলো নির্দিষ্ট একটি টোকেন দেখিয়ে। এই টোকেন দেখানো হলে কেউ আর ট্রাক আটকায় না। পুলিশের পাশাপাশি চোরাকারবারিদের একটি চক্র মোটরসাইকেল মহড়ায় এই সব অবৈধ ভারতীয় চিনির ট্রাক সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রবেশ মুখহাসন রাজার তোরণ পর্যন্ত পৌছে দিচ্ছে টাকার বিনিময়ে।
এদিকে অবৈধ ভারতীয় চিনি চোরাকারবারিদের একজন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাসিন্দা সাইফুলের সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, সীমান্ত এলাকায় ২০ থেকে ২২ জন এই রকম ব্যবসায়ী রয়েছেন। যারা পুলিশসহ বিভিন্নজনকে ভাগ দিয়ে এই চিনির ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০২২ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ অভিযানে সুনামগঞ্জে ১৯২.৯ মেট্রিক টন চিনি জব্দ করা হয়, যার বাজার মূল্য ১ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। সেই সাথে ১৯৭ জন চোরাকারবারিকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ জড়িত থাকার বিষয়ে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ্ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।