বঙ্গবন্ধুর খুনি এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে নিয়ে কানাডা সরকার লুকোচুরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। শনিবার রাত সাড়ে ৭টায় সিলেট নগরীর ধোপাদিঘীর পাড়স্থ মন্ত্রীর নিজ বাসভবন হাফিজ কমপ্লেক্সে কালবেলার সঙ্গে একান্তে আলাপচারিতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মন্ত্রী বলেন, নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি। জোরোসোরে তিনি বলেছেন, ‘তিনি বঙ্গবন্ধুকে মেরেছেন’। এরপরই তিনি কানাডায় গিয়ে আশ্রয়ে প্রার্থনা করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কানাডা সরকারের সাথে এ নিয়ে আমরা অনেকবার দেন-দরবার করেছি। আমরা কানাডা সররকারকে বলেছি যে, আপনার দেশ আইনের শাসনের দেশ, সুশাসনের দেশ। আমরা আমাদের দেশে আইনের দেশ তৈরি করতে চাই। রোল অব ল’ আমাদের দেশে করতে চাই। আপনারা প্রায়ই চিৎকার দেন, আমাদের দেশে সুশাসন, রোল অব ল’ কম। আমরা সব খুনিদের, যারা পলাতক, তাদেরকে দেশে এনে আইনের সম্মুখীন করতে চাই।’
‘কানাডা সরকার সেটা শুনেন, কিন্তু এই খুনিকে তারা নানা অজুহাতে আমাদের দেশে পাঠান না। ওনারা বলেন যে, এই খুনির বিচার হয়েছে, বিচারের তার শাস্তি হয়েছে, আমাদের দেশে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।’
তিনি বলে, ‘কানাডা সরকার বলেন যে, মানুষের মৃত্যুদণ্ডের বিচারে আমরা খুশি না। আমরা চাই না কোনো লোকের মৃত্যুদণ্ড হোক। আমরা বললাম যে, এই লোক তো বাঙালি, বাংলাদেশি নাগরিক, আপনার দেশের নাগরিক না। সুতরাং তাকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেন। তারা বলেন, ‘না, আপনার দেশে গেলে বিচারের সম্মুখীন হবে, এটা আমাদের আইনে মানে না। আমরা তখন জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোকের স্ট্যাটাসটা কি? ওনার বলেন না। লুকিয়ে রাখেন। লুকোচুরি খেলেন। আমরা তাই, কানাডিয়ান কোর্টে ওকিল নিয়োগ করলাম, কোর্টে আমরা কেইস করলাম যে, আমরা জানতে চাই, এই নূর চৌধুরী কি কানাডিয়ান নাগরিক না বাংলাদেশি নাগরিক। কানাডিয়ান সরকার, কানাডিয়ান কোর্ট রায় দিল, সে নাগরিক না সে এখানে অবৈধভাবে আছে, সেইটা কানাডিয়ান সরকার বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে পারেন। কিন্তু এরপরও কানাডিয়ান সরকার এই লুকোচুরিতে আছে। সে কি বৈধ নাকি কানাডিয়ান আশ্রয় পেয়েছে সেইটা আমরা জানি না।’
আলাপকালে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কানাডিয়ান সরকারকে বললাম যে, বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় স্বজন দিনে দিনে দুঃখ পাচ্ছে, আর খুনি নূর চৌধুরী তো দিব্যি শান্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমরা একে প্রতিমাসে টাকাও দিচ্ছ, তোমাদের দেশে থাকার জন্য সে বাড়িতে আছে, দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সিনেমা দেখতেছে। তোমরা আমাদের দেশের না পাঠাও, তাহলে তোমাদের দেশের জেলে রাখো। তারা কোনো উত্তর দেন না। আমরা অনেকবার তাদেরকে বলেছি। কিন্তু তারা কিছুই বলে না। একটা না একটা অজুহাত তুলে ধরেন।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বলি যে দেখো, তোমরা এমন খুনিগুলোকে আশ্রয় দিলে, কানাডা একটি খুনিদের কেন্দ্রে পরিণত হবে। দুনিয়ার যত খুনিরা সব তোমাদের দেশে গিয়ে আশ্রয় নিবে। সুতারাং তোমরা পৃথিবীর সব দেশের জন্য একটি অনিষ্টের কারণ হবে। তোমরা তাকে যদি ফাঁসি না দেও, তাইলে জেলে রাখো। সেইটাও করেনা।
প্রবাসীদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কানাডায় বাঙলি প্রবাসী যারা আছেন, আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম যে আপনারা, প্রবাসী বাঙালি যারা, এই আত্মস্বীকৃত খুনি নূর, সে যে বাড়িতে থাকে, যেসব এলাকায় সে ঘুরে বেড়ায়, আপনার সেইখানে অন্তত পক্ষে মাসে একবার গিয়ে প্রতিবাদ করেন, প্ল্যাকার্ড দেখান যে, এইখানে খুনি থাকে। ওইখানকার কানাডাবাসিকে বলেন, আপনাদের বাড়ির পাশে একজন আত্মস্মীকৃত খুনি থাকে। একে আপনারা আপনার এলাকা থেকে বের করে দেন, কিন্তু এইগুলো হয়না।
সিভিসি রিপোর্টারের ভিডিও দেখে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে, একজন লোক একটা ভিডিও তৈরি করেছে। এরকম আরো আরো ভিডিও হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর খুনি এখনো ৫টি পলাতক আছে। একটি কানাডায়, একটা আমেরিকায়, বাকি ৩টা জানি না। আমি সব প্রবাসী ভাইবোনদেরও বলেছি, আপনারা যদি বাকি খুনিদেরও তথ্য দিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আপনাদের আমরা পুরস্কৃত করব।’
প্রবাসীদের উদ্দেশে একজন খুনিকে ধরিয়ে দেওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘একটি খুনি বোস্টনের সামার বিলে ছিল। সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি লোকদের মারতে সাহায্য করে। ইহুদী লোকদের সে বলে, এই যে গ্যাস চেম্বার এইগুলো মিথ্যা-বানোয়াট। তারপরেও তার বাড়ির সামনে প্রায় সপ্তাহেই মিডিয়া সহ যারা ইহুদি স্বপক্ষের লোক, তারা বিচারের সম্মুখীন করার জন্য ওই লোকের বাড়ির সামনের গিয়ে প্রতিবাদ করত। সে লোক পরে আমেরিকান নাগরিক হয়েছিল। আমেরিকান সরকার ওই নাগরিককে যিনি ওই জুইস হ্যালোকাস্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাকে ইসরাইলে পাঠিয়ে দেয়। আমরা আশা করি, কানাডিয়ান সরকার এই খুনিকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিবে।’
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে জড়িত এই এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ১৯৫০ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এম এ নূর। তাকে নিয়ে বিশদ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করতে যাচ্ছে কানাডিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিবিসি। যে প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আত্মগোপনে থাকা নূর চৌধুরীর দেখা মিলবে। জানা যাবে, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার ভাষ্যও। এর আগেই সম্প্রতি ওই প্রতিবেদনের একটি খণ্ডিত একটি ভিডিওতে তাকে দেখা যায়। এরপর থেকেই আবারও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। জনগণ জানতে চায়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরানোর কি উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।